আমি বাসায় ফিরেছি অফিসের কাজ শেষে, প্রচণ্ড ক্লান্ত। টং দোকান থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে হাঁটছিলাম রাস্তা ধরে। আব্বুর গাড়ি থাকলেও আমি কখনো সেটা ব্যবহার করতাম না। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করে ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। আশপাশের সবাই ছাউনি খুঁজে আশ্রয় নিচ্ছে। কিন্তু আমার এসব নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। বৃষ্টিতে ভেজা বরাবরই আমার ভালো লাগে।
বৃষ্টি ভিজতে ভিজতে হঠাৎ চোখ পড়ল রাস্তার একপাশে। একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরাতে পারলাম না। মনে হলো যেন কোনো পরী মর্ত্যে নেমে এসেছে। এতটা নিখুঁত সৌন্দর্য আমি আগে কখনো দেখিনি। মেয়েটি একদম চুপচাপ বৃষ্টিতে ভিজছিল। প্রথমে ভাবলাম হয়তো বৃষ্টি পছন্দ করে। কিন্তু তাই বলে এভাবে? তাছাড়া চেহারায় এমন একটা গাম্ভীর্য, মনে হয় বড়লোকের মেয়ে।
কিন্তু যতবার তার দিকে তাকাই, ততবারই সে যেন আরও সুন্দর হয়ে ওঠে। হঠাৎ দেখলাম একটা ছেলে তার হাত ধরে রাস্তা পার করে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হলো, মেয়েটি চোখে দেখতে পায় না। তার হাত ধরে থাকা ভঙ্গি কিংবা রাস্তার দিকে হাতড়ানোর চেষ্টা সেদিকেই ইঙ্গিত করছিল।
সেদিন বাসায় ফিরে মনটা কিছুতেই স্থির হলো না। মাথার মধ্যে শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে সেই মেয়েটির মুখ।
Bengali best romantic love story
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই মনে হলো যেন স্বপ্নে দেখেছি তাকে। তার হাত ধরে হাঁটছি, হাসি বিনিময় করছি। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত ঠেকল। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে এগুলো নেহাতই কল্পনা। মনের ভুল। কিন্তু একবার যাকে দেখলে, তাকে কি আর এত সহজে ভুলে থাকা যায়?
সপ্তাহখানেক পর বিকেলে নাহিদ ফোন করল। বলল তার বাসার দিকে যেতে। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। পথে হঠাৎ মাধবী কলোনির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা ব্যালকনিতে সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে। দুপাশে ঝুলন্ত ফুলের টব, গ্রীলের সঙ্গে হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে হলো যেন সময় থমকে গেছে। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে এতটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে নাহিদের ফোনের শব্দেও ধাক্কা খেলাম না।
নাহিদের বাসায় পৌঁছে আড্ডা দিতে গিয়েও মন পড়ে রইল সেই মেয়েটার কাছে। শেষে নাহিদকে সব বললাম। শুনে সে বলল, মেয়েটিকে সে চেনে। জন্মান্ধ মেয়েটা। তবে অদ্ভুত সুন্দর। কিন্তু তার এই সমস্যার কারণে কেউই তার পাশে থাকার সাহস করে না।
নাহিদের কথা শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতদিন নিজেকে যথেষ্ট বাস্তববাদী ভেবেছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম, ভালোবাসা বাস্তবতা মানে না। আমার মন কেবল একটাই কথা বলছিল, “ওকে ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ।”
এরপরও অনেক দ্বিধা ছিল। ভেবেছিলাম, আমি কি পারব এমন একজন মানুষকে নিজের জীবনে জায়গা দিতে? কিন্তু আবার মনে হলো, প্রেম মানেই তো ত্যাগ। আর আমি তো নিজেকে তার জন্য সঁপে দিতে রাজি।
পরের কয়েক সপ্তাহে প্রায়ই মাধবী কলোনির সামনে দিয়ে যেতাম। ভেতরে ভেতরে একটা সাহস সঞ্চয় করছিলাম। একদিন সেই মেয়েটিকে পথের ধারে দাঁড়িয়ে পেলাম। নিজের সমস্ত জড়তা কাটিয়ে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। আমার নাম শুভ্র, সে জানল। তার নাম মায়া।
আমাদের পরিচয়ের শুরুটা সেখান থেকেই। ধীরে ধীরে আমাদের বন্ধন গভীর হলো। মায়ার সরলতা, তার ভিতরের শক্তি আমাকে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ করত। সে আমাকে জানাল, তার পৃথিবীটা ছোট। কিন্তু তবুও সে তার জীবনের জন্য কখনো কাউকে দোষ দেয়নি। বরং অন্যের চোখে পৃথিবী দেখাই ছিল তার সবচেয়ে বড় আনন্দ।
আমাদের সম্পর্কটা এমন জায়গায় পৌঁছল যে আমি একদিন মায়াকে প্রপোজ করলাম। প্রথমে সে রাজি হয়নি। বলল, “তোমার মতো সুদর্শন, সপ্রতিভ একজন পুরুষের পাশে একজন অন্ধ মেয়ে মানায় না।” আমি জবাব দিলাম, “তোমার বাহ্যিক সৌন্দর্যই তো আমাকে প্রথমে মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু তোমার মনের সৌন্দর্য আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।”
Bangla one side love story 2025
সেদিন মায়া আমার হাত ধরে বলল, “তোমার মতো মানুষ পাশে থাকলে জীবনটা সত্যিই সুন্দর হতে পারে।”
আজ আমরা একসঙ্গে আছি। মায়ার প্রতিটি অভিমান, রাগ আমার কাছে আশীর্বাদের মতো। আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভালোবাসায় ভরা। মায়ার হাত ধরে প্রতিদিন আমি তাকে আমার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখাই। আর প্রতিদিন নতুন করে প্রেমে পড়ি তার।
আমাদের একসঙ্গে থাকার সময়টা যেন স্বপ্নের মতো কাটছিল। মায়ার হাত ধরে প্রতিদিন নতুন কোনো জায়গায় যাওয়া, তাকে আমার চোখ দিয়ে পৃথিবী দেখানো—সবকিছুই আমাদের জীবনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি চাইতাম মায়ার জীবনে কোনো খামতি যেন না থাকে। অথচ কখনো কখনো মনে হতো, আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, তার অন্ধত্বের সীমাবদ্ধতাকে আমি পুরোপুরি ভুলিয়ে দিতে পারব না।
একদিন সন্ধ্যাবেলায় মায়া আমাকে বলল,
“শুভ্র, তুমি কি জানো, তোমার চোখে পৃথিবী দেখা আমার জন্য কতটা মূল্যবান? কিন্তু কখনো কখনো মনে হয়, আমি কি তোমার জীবনের বোঝা হয়ে যাচ্ছি না?”
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তার চোখে অদ্ভুত একটা বিষণ্ণতা। বললাম,
“মায়া, তুমি কী বলছো এসব? তুমি আমার জীবন, আমার অস্তিত্ব। আমি তো তোমার থেকে বেশি কিছু চাই না।”
মায়া একটুও হেসে উঠল না। বরং তার গলায় যেন কষ্টের সুর ফুটে উঠল।
“আমি জানি, শুভ্র। কিন্তু আমি চাই না তুমি আমাকে নিয়ে সারাজীবন সীমাবদ্ধ থাকো। তুমি তো চাইলে আরও সহজ একটা জীবন বেছে নিতে পারতে।”
আমি মায়ার হাত শক্ত করে ধরলাম।
“মায়া, ভালোবাসা কোনো ‘সহজ’ আর ‘কঠিন’ বুঝে না। তোমাকে ভালোবেসেছি মানেই আমার কাছে তুমি পরিপূর্ণ। তুমি বোঝো না, আমি তোমাকে যতটা সাহস দিই, তুমি আমাকে তার চেয়ে দশগুণ বেশি শক্তি দাও।”
আমার কথা শুনে মায়া একটু শান্ত হলো। কিন্তু সেদিনই বুঝেছিলাম, তার মনে কোথাও একটা গভীর অস্বস্তি লুকিয়ে আছে।
এরপর আমাদের জীবনে কিছু নতুন বাঁক এলো। আমি চাকরি ছেড়ে একটা ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলাম, যাতে মায়ার পাশে আরও বেশি সময় কাটাতে পারি। মায়ার একটা স্বপ্ন ছিল—একদিন সে নিজের মতো কিছু করবে। তার ইচ্ছা ছিল, অন্ধদের জন্য একটা স্কুল খুলবে। সে চেয়েছিল, যারা তার মতো দেখতে পায় না, তারা যেন স্বপ্ন দেখতে শেখে, হাল ছেড়ে না দেয়।
আমরা সেই স্বপ্নটা নিয়ে কাজ শুরু করলাম। প্রথমে ছোট আকারে, কয়েকজন ছাত্রছাত্রী নিয়ে। মায়া তাদের সঙ্গে অনেক সময় কাটাত। তাদের অনুভব করত, তাদের জীবনের গল্প শুনত। স্কুলটা ধীরে ধীরে বড় হতে লাগল। মায়ার হাসি যেন প্রতিদিন আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠত।
একদিন মায়া আমাকে বলল,
“শুভ্র, জানো? আগে মনে হতো আমার জীবনটা শুধু অন্ধকারে ঘেরা। কিন্তু তুমি এসেছ, আর আজ এই বাচ্চারা এসেছে। এখন আমার মনে হয়, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মেয়ে।”
আমি মায়ার এই পরিবর্তন দেখে খুশি ছিলাম। তার জীবনটা যেন একেবারে নতুন রঙে ভরে উঠেছে।
Bangla Valobasar Golpo
কিন্তু ঠিক তখনই জীবনে আবার একটা কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হলো। মায়ার শরীরের একটা ছোট্ট সমস্যা ধীরে ধীরে বড় আকার ধারণ করল। একদিন তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তার বললেন,
“মায়ার দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে তার জন্য অপারেশন করতে হবে। আর সেটা খুব জটিল।”
এই কথাটা শুনে আমি যেন স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতদিন ধরে যেটা অসম্ভব ভেবেছি, সেটা যদি সম্ভব হয়, তবে মায়ার জীবনটাই বদলে যাবে। কিন্তু অপারেশনের জটিলতা আর ঝুঁকির কথা শুনে আমার ভেতরটা ভেঙে পড়ল।
ডাক্তার বললেন,
“মায়া যদি চায়, আমরা অপারেশন করতে পারি। তবে সফলতার কোনো নিশ্চয়তা দিতে পারছি না।”
আমি মায়াকে এই খবরটা জানালাম। প্রথমে সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। তার চোখে এক ঝলক আলো দেখা দিল, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেটা ম্লান হয়ে গেল।
“শুভ্র, যদি অপারেশন ব্যর্থ হয়, তখন কী হবে? আমি কি আবার সব হারাব?”
আমি তার হাত ধরে বললাম,
“মায়া, এই সুযোগ একবারই আসে। তুমি যদি সাহস করো, আমি তোমার পাশে আছি। তুমি দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাও, বা না পাও, আমি তো তোমাকে কোনোভাবেই হারাব না।”
মায়া অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। তারপর বলল,
“ঠিক আছে, শুভ্র। আমি সাহস করব। তোমার বিশ্বাসই আমার ভরসা।”
অপারেশনের দিন এসে গেল। হাসপাতালের করিডোরে বসে আমার মনে হচ্ছিল সময় থেমে গেছে। প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক বছরের মতো দীর্ঘ। অপারেশন চলল প্রায় পাঁচ ঘণ্টা।
অবশেষে ডাক্তার এসে বললেন,
“অপারেশন সফল হয়েছে। তবে মায়াকে এখনও কয়েকদিন পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। তার দৃষ্টিশক্তি ধীরে ধীরে ফিরে আসবে।”
Bangla romantic love story
এই কথা শোনার পর আমার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আমি ছুটে গেলাম মায়ার কাছে। তার চোখে একটা ব্যান্ডেজ ছিল, কিন্তু মুখে সেই পরিচিত হাসি।
সে ধীরে ধীরে বলল,
“শুভ্র, আমি তোমার মুখ দেখতে পারব?”
আমি তার হাত ধরলাম।
“হ্যাঁ, মায়া। খুব তাড়াতাড়ি তুমি সবকিছু দেখতে পাবে।”
কয়েকদিনের মধ্যে মায়ার চোখ থেকে ব্যান্ডেজ খুলে দেওয়া হলো। প্রথমে সে একটু বিভ্রান্ত ছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার দৃষ্টিশক্তি ফিরে এল। যখন সে আমার দিকে তাকাল, তার চোখে যেন এক অদ্ভুত আলো। সে আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল,
“তুমি ঠিক যেমনটা কল্পনা করেছিলাম, শুভ্র, তেমনই। তবে আরও সুন্দর।”
আমি হেসে বললাম,
“তোমার চোখে দেখলে তো সবকিছুই সুন্দর লাগে।”
আমাদের জীবনের সেই মুহূর্তটা যেন একটা নতুন শুরু ছিল। মায়া এখন শুধু আমার ভালোবাসার অংশ নয়, সে নিজের স্বপ্নও বাস্তবায়ন করছে। আমাদের স্কুলটা এখন আরও বড় হয়েছে। আমরা একসঙ্গে প্রতিদিন নতুন স্বপ্ন দেখি, নতুন গল্প লিখি।
আমার কাছে মায়া শুধু একজন নারী নয়, সে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।