এই গল্পটি আরো গভীর মানবীয় অনুভূতি, রোমান্টিকতা এবং কিছু মোড় দিয়ে পুনরায় লিখলাম—
শীতের রাত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। জানালার ফাঁক দিয়ে আসা হিমেল বাতাস শরীর গুলিয়ে দিচ্ছে। অথচ সামু শুয়ে আছে খালি গায়ে, কম্বল কিংবা চাদর নেই। মাথার উপরে ফ্যানটা অন করা। শাস্তি চলছে তার। আর পাশে বসে ইতু, গায়ে মোটা কম্বল জড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। সামুর অবস্থা দেখে হাসি চেপে রাখতে পারছে না।
“ইতু, শীত লাগছে। কাথাটা দাও না?” সামু মিনমিন করে বলল।
ইতু পিঠ ঘুরিয়ে একগাল রাগ দেখিয়ে বলল, “এখন শীত এল কিভাবে? সকালে মনে ছিল না?”
“ওটা ভুল হয়ে গেছে, আমার কি দোষ বলো!” সামু একটু অসহায়ভাবে জবাব দিল।
ইতু এবার চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি জানো না, তোমার এমন অবহেলায় আমি কতটা কষ্ট পাই? সকালে তোমার জন্য কত কেঁদেছি, জানো? এখন তুমি ঠান্ডায় থাকো। আমি তোমার রাগ সুদে-আসলে মিটিয়ে দেব।”
সামু বুঝে গেল, ক্ষমার আশা নেই। তাই নাটক শুরু করল, “ঠিক আছে, আমি ছাদে গিয়েই ঘুমাব খালি গায়ে। আমার অসুস্থ হলে কারও কি আসে যায়!”
এই বলে উঠে পড়তেই ইতু হাত ধরে টান মেরে বিছানায় বসিয়ে দিল। কাথা গায়ে জড়িয়ে দিলেও মুখে গোমড়া রাগ। “ভাবোনা, কুত্তা, আমি গলে গেছি। আমার রাগ এখনো আছে। কথা বলবে না আমার সঙ্গে!”
সামু ইতুর রাগান্বিত মুখের দিকে চেয়ে রইল। ওর রাগটা যেন আরো মায়াবী হয়ে উঠেছে। ইতুর ঠোঁট কাঁপছে, নাক ফুলছে, আর চোখে লুকানো অভিমান। সামু একটু হাসতে হাসতে বলল, “তোমার রাগও তো একদম আমার মতোই সুন্দর!”
“চুপ! একদম চুপ!” ইতু রাগ দেখিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। কিন্তু সামু এবার সাহস করে এগিয়ে গেল। আস্তে করে ইতুর কাঁধে হাত বুলাতেই সে লাফ দিয়ে বলল, “কুত্তা! আমাকে আরেকবার বিরক্ত করলেই দেখো!”
সামু একটু হেসে বলল, “তুমি তো এমনিই সুন্দর! রাগ করলেও যেন তোমাকে আরও ভালো লাগে।”
ইতু রাগ ভেঙে মুচকি হেসে বলল, “তুমি আমাকে রাগিয়েও ছাড়বে না, তাই না?”
সামু আর দেরি করল না। ইতুর হাত ধরে বলল, “চলো, আজ তোমার একটা ইচ্ছে পূরণ করি।”
ইতু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “ইচ্ছে? কোন ইচ্ছে?”
সামু স্মৃতিতে ফিরে গেল। বিয়ের আগের সেই রাত, যখন মাঝরাতে ইতু ফোন করে বলেছিল, “আমার খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে নিয়ে শীতের রাতে হাঁটতে বেরোই। কিন্তু তখন তো পারলে না।”
সামু এবার ইতুকে কোলে তুলে নিল। ইতু চমকে গিয়ে বলল, “এই! এটা কি হচ্ছে?”
সামু কিছু বলল না। কেবল দুজন এক চাদর গায়ে দিয়ে বাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে এল। চারদিক নীরব, জনশূন্য রাস্তা। নীলচে নিয়নের আলো যেন তাদের সঙ্গ দিচ্ছে।
হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে চলে গেল তারা। পথের মাঝে ইতু নিচে নেমে দাঁড়াল। সামুর পায়ের আঙুলে চাপ দিয়ে দাঁড়িয়ে তার ঠোঁটে আলতো চুমু খেল। ঝাপটে ধরল বুকের মাঝে। সামু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমি জানো না, তোমার এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আমার পুরো জীবনটা সাজিয়ে দেয়।”
ইতু কিছু বলল না। শুধু মাথাটা সামুর বুকের ঠিক মাঝখানে গুজে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তুমি না থাকলে আমি একদম শূন্য। তুমি ছাড়া আমার কোনো জীবন নেই।”
সেই রাতের হিমেল হাওয়ায় তাদের ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। দুজন দুজনকে শক্ত করে ধরে রেখেই জানল, তাদের জীবন একে অপরের সঙ্গে জুড়ে গেছে, চিরকালের জন্য।
শীতের সেই গভীর রাতের ভালোবাসার মুহূর্তগুলো দুজনের মনের মধ্যে গেঁথে ছিল। কিন্তু ভালোবাসা কেবল মুহূর্ত নয়, কখনো কখনো তা পরীক্ষার সামনে পড়ে। পরদিন সকালে, রোদ্দুর একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠলেও তাদের মনের আকাশে যেন কিছুটা মেঘ জমে ছিল।
ইতু কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছিল। সামু ওর পাশে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। হাত দিয়ে আস্তে করে ইতুর চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বলল, “কাল রাতটা যেন স্বপ্নের মতো ছিল। কিন্তু তুমি জানো, আমি চাই তোমার জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়তে। আর সে জন্য হয়তো আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে।”
ইতু প্যান হাতে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার এই পরিশ্রমের কথা শুনলে আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হয়। তুমি সবসময় নিজের কথা ভুলে আমার জন্য সব করছ, কিন্তু নিজের শরীরের যত্ন তো একদম নিচ্ছ না। তুমি এমন করলে, আমি কিভাবে শান্তি পাব?”
সামু ইতুর হাতে হাত রেখে বলল, “তুমি তো আমার শান্তি। আমি তোমার মুখের হাসিটা দেখলেই সব ক্লান্তি ভুলে যাই।”
ইতু এক গাল হেসে বলল, “তাহলে কথা দাও, এখন থেকে তুমি নিজের শরীরের খেয়াল রাখবে। তুমি সুস্থ থাকলে তবেই আমি সুখী হব।”
সামু একটু হাসল, “তোমার জন্য আমি সব করতে রাজি। আচ্ছা, বলো তো, তোমার আর কি ইচ্ছে আছে? কাল রাতের মতো কোনো পাগলামি কি করতে চাও?”
ইতু একটু চুপ থেকে বলল, “আচ্ছা, তুমি কি জানো, আমার একটা পুরনো ইচ্ছে ছিল? আমি বরাবরই চেয়েছি, কোনোদিন ভোরবেলা তোমার সঙ্গে হিল স্টেশনের রাস্তা ধরে হাত ধরে হাঁটব। সেখানে চারপাশে শুধু কুয়াশা থাকবে আর থাকবে আমাদের দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ। এমন একটা মুহূর্ত চাই আমি।”
সামু গভীরভাবে ইতুর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার প্রতিটা ইচ্ছে পূরণ করব। আজই আমরা প্ল্যান করি। পরের সপ্তাহে ছুটি নিয়ে হিল স্টেশনে চলি। কেমন হবে?”
ইতুর মুখে উজ্জ্বল হাসি ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু হঠাৎ সে একটু গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি তো বলছ ছুটি নেবে, কিন্তু কাজের চাপের জন্য আবার পিছিয়ে দেবে না তো?”
সামু ইতুর কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল, “তোমার সঙ্গে সময় কাটানো আমার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাধান্য। আমি কথা দিচ্ছি, তোমার ইচ্ছেপূরণ করব।”
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। সামু কাজের চাপ সামলাচ্ছিল, আর ইতু সেই ভোরবেলার হিল স্টেশন ভ্রমণের স্বপ্নে বিভোর ছিল।
যে দিনটায় তারা বেরোবে ঠিক করেছিল, সেই দিন ভোরে রোদ উঠার আগে দুজন রওনা দিল। গাড়ির জানালা দিয়ে পাহাড়ের ঠান্ডা বাতাস ঢুকছিল। ইতু মাথাটা সামুর কাঁধে হেলিয়ে দিয়ে বলল, “তুমি জানো, এই মুহূর্তগুলো আমার কাছে জীবনের চেয়েও দামি।”
সামু গাড়ি চালাতে চালাতে হাসল। “তাহলে তো আমরা জীবনের সবচেয়ে দামি মুহূর্তে আছি।”
হিল স্টেশনে পৌঁছে, রোদ ওঠার আগেই তারা একসঙ্গে হাঁটা শুরু করল। কুয়াশায় ভিজে থাকা রাস্তার উপর দুজন এক চাদর ভাগ করে নিল। চারপাশে পাখিদের ডাক, আর ঠান্ডা বাতাস তাদের দুজনের নীরবতাকে আরো গভীর করছিল।
একটা জায়গায় এসে তারা থামল। সামু হঠাৎ ইতুর হাত ধরে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, “তোমাকে কিছু বলতে চাই। জীবন অনেক কঠিন হতে পারে, কিন্তু যতদিন তুমি আমার পাশে থাকবে, আমি সব সামলে নিতে পারব। আমার প্রতিটা মুহূর্ত তোমার জন্য উৎসর্গ করতে চাই।”
ইতুর চোখে জল এসে গেল। “তুমি আমার জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। আমি কখনো চাইনি কারো কাছে নিখুঁত কিছু। শুধু তোমার মতো একজনকে চেয়েছিলাম, যে আমাকে বুঝবে। আর তুমি সেটা করছ।”

সামু উঠে এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। “তাহলে প্রতিশ্রুতি দাও, আমাদের জীবন যত কঠিনই হোক, আমরা একসঙ্গে সবকিছু সামলে নেব।”
ইতু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল। কুয়াশার ভেতর তাদের জড়িয়ে ধরা ছায়া যেন সময়ের মায়ায় গেঁথে গেল।
সে মুহূর্তগুলো তাদের ভালোবাসার একটা নতুন অধ্যায় লিখে দিল। আর সেই ভোরবেলার কুয়াশা সাক্ষী হয়ে রইল তাদের অটুট সম্পর্কের।