সকালে ঘুমাচ্ছিলাম, হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ একজন আমার আঙুলে কামড় দিয়েছে। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠলাম, আর ঠিক তখনই কানে ভেসে এলো এফএম ৮৮.৮-এর গান। ঘুমের ঘোর, কামড়ের ব্যথা, আর সেই গান—সব মিলে যেন এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়ে গেল।
আমি বিরক্ত হয়ে চিৎকার করলাম, “আল্লাহ! শান্তিতে একটু ঘুমাতেও দেবে না কেউ!”
আপনারা ভাবছেন, রেডিওটা কে বাজাচ্ছে? সে হল আমার দুই বছরের “গুণধর” মেয়ে, চাঁদনী। আর এই পরিকল্পনা সফল করতে তার সঙ্গী আমার প্রিয় বউ জান্নাত। চাঁদনী যখন কান্না জুড়ে দিল, তখন জান্নাতকে ডাকলাম।
“জান্নাত! জান্নাত! তুমি সকাল সকাল এমন অঘটন ঘটাচ্ছ কেন?”
জান্নাত দরজার বাইরে থেকে জবাব দিল, “চিল্লাও কেন? তোমাকে উঠাতে পারব না, তাই চাঁদনীকে পাঠিয়েছি। সামান্য একটা কামড়, এত ড্রামা করতে হবে?”
আমি হাল ছেড়ে দিলাম। তবে মনে মনে ভাবলাম, “তোমার এই চালাকির প্রতিশোধ তো একদিন আমি নেব।”
ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে গেলাম। দাঁতের মাজন করতে করতে ভাবতে লাগলাম আমাদের গল্প।
আমি ফারুক। নিজের ব্যবসা করি। আমার বউ জান্নাত একসময় ছিল আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আমরা ক্লাস নাইনে পড়ার সময় থেকেই একে অপরকে চিনতাম। জান্নাতকে ভালোবাসতাম, কিন্তু সেটা কখনও বলতে পারিনি।
জীবন ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। একদিন জান্নাত জানাল, তার বিয়ে ঠিক হয়েছে। কথাটা শুনে আমার ভেতরে সব কিছু ভেঙে পড়ল। কিন্তু আমি কিছু করতে পারিনি। ১৯ তারিখে তার বিয়ে ছিল। ওইদিন সকালে তার মিসড কলের সংখ্যা ছিল ২৪। আমি ফোন করতেই শুনি, তার হবু বর পালিয়েছে।
জান্নাতের মা বললেন, “তুমি যদি চাও, তাকে বিয়ে করতে পারো।”
আমার মনের আকাশে যেন রোদ উঠল। সেদিনই আমরা বিয়ে করলাম। তখন জানতাম না, আমাদের জীবনে কত দারুণ মুহূর্ত আসছে।
একদিন বিকেলে জান্নাতের বেস্ট ফ্রেন্ড পনির বাড়ি যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু সেদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। বাড়ি ফেরার পথে বাইকের সামনে এক মেয়ে চলে এলো। আমি পড়ে গেলাম, আর মেয়েটা গুরুতর আহত হলো। তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮টা বেজে গেল।
বাড়ি পৌঁছে জান্নাতকে সব বললাম। কিন্তু সে বিশ্বাস করল না। রাগে আমাকে বেইমান বলে বসলো। আমার মাথা গরম হয়ে গেল।
তাকে নিয়ে সোজা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। জান্নাত সেখানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড পনিকে দেখে হতবাক। পনি বলল, “জান্নাত, এটা তোর বর? যে আমার বোনকে রক্ষা করেছে?”
জান্নাত তখন বুঝল, সে ভুল করেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে ক্ষমা চাইল। আমি তাকে ক্ষমা করলাম, তবে বললাম, “আর যেন ভুল না করো।”
আমাদের সম্পর্ক আরও গভীর হলো সেদিন। প্রেমে যেমন ভুল হয়, তেমন ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভালোবাসা আরও শক্তিশালী হয়।
সকালটা ছিল যেন আগের দিনেরই ধারাবাহিকতা। চাঁদনী উঠে পুরো বাসা মাথায় তুলছে। আমি অফিসের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, আর জান্নাত রান্নাঘরে নাশতা বানাচ্ছে। কিন্তু একটা জিনিস বুঝলাম—জান্নাত আজ আমাকে পুরোপুরি ইগনোর করছে। বউয়ের মেজাজ ভালো নেই মানে দিনটা কেমন কাটবে, তা ভাবতেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালাম। জান্নাত পাশ দিয়ে গেল, চোখ তুলেও তাকাল না। খালি বলে গেল,
“চাঁদনী দেখিস! আজ দুপুরে যেন আব্বুর অফিসে ফোন দিয়ে তুই কোন অভিযোগ করিস না।”
আমি জিজ্ঞাসা করলাম,
“এই জান, আবার কি ভুল করলাম?”
ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,
“ভুল? আমি কিছু বলিনি তো! ভুল তো করো তুমি। এখন তো আমি কিছু বলারও অধিকার রাখি না, তাই না?”
এই বলে ও কিচেনের ভেতর ঢুকে গেল। আমি জানি, গতকালের এক্সিডেন্ট নিয়ে ও এখনো অভিমান করছে।
অফিসে পৌঁছে কাজের ফাঁকে বসে আছি। এমন সময় ফোনটা বেজে উঠল। জান্নাতের নাম দেখে ভাবলাম, “এই বুঝি মেজাজ ঠান্ডা হয়ে গেল!”
কিন্তু ফোন ধরতেই ও বলল,
“তোমার একটা সারপ্রাইজ আছে। সন্ধ্যায় তাড়াতাড়ি বাসায় আসবা।”
আমি বললাম,
“আবার কি প্ল্যান জান, বল তো!”
ও খিলখিল করে হেসে বলল,
“বেশি জিজ্ঞাসা করিস না। সারপ্রাইজ তো সারপ্রাইজ-ই থাকবে। আর শোনো, আজ কাজ শেষে চাঁদনীকে নিয়ে পার্কে যাও। ওর বাবা নাকি শুধু অফিস করে, তাই ওর সাথে সময় কাটানোর সময় নেই।”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
“ম্যাডাম, আপনি যা বলবেন, তাই করব। আর তুমি কি করবা, তা কি জানার সুযোগ পাব?”
ও বলল,
“না। আজ আমি আমার মতো করব। এখন ফোন রাখো, খালি কথা বললে হবে না, কাজও করতে হয়।”
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি পুরো ঘর রঙিন বাতি দিয়ে সাজানো। জান্নাত আমার দিকে একবার তাকাল, কিন্তু কোনো কথা বলল না। ওর গায়ে একটা নতুন লাল শাড়ি, কপালে টিপ, আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। আমি কিছু বলার আগেই চাঁদনী দৌড়ে এসে বলল,
“পাপ্পা! দেখো, আম্মু তোমার জন্য কত কিছু বানিয়েছে। কিন্তু তুমি আম্মুকে কিছু দাও নাই!”
আমি একটু হেসে চাঁদনীকে কোলে তুলে বললাম,
“আমার জান যে রেগে থাকে, ওর রাগ ভাঙাতে কি করব, সেটাই তো ভাবছিলাম।”
চাঁদনী ফিসফিস করে বলল,
“তুমি একটা চুমু দাও। আম্মু খুশি হবে!”
আমি জান্নাতের দিকে তাকালাম। ও আমার চোখে চোখ রেখে বলল,
“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। নিজের বুদ্ধি দিয়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করো।”
আমি তখন পকেট থেকে একটা ছোট্ট রিং বের করে জান্নাতের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললাম,
“জান, তোমাকে ভালোবাসার জন্য হাজারটা কারণ দরকার নেই। আমি তোমাকে ভালোবাসি কারণ তুমি জান্নাত। চলো, নতুন করে আবার প্রেম শুরু করি।”
জান্নাত প্রথমে রাগ দেখানোর চেষ্টা করল, কিন্তু হাসি চেপে রাখতে পারল না। চাঁদনী খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল,
“পাপ্পি! তোমরা দুজনেই ফাজিল!”
সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু একদিন জান্নাত আমাকে একটা শক দিল। ও বলল,
“শুনো, আমি একটা নতুন ব্যবসা শুরু করতে চাই। কিন্তু তোমার সাহায্য লাগবে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
“ব্যবসা? তুমি কবে থেকে এসব ভাবতে শুরু করলে?”
জান্নাত বলল,
“তোমার মতোই আমারও স্বপ্ন আছে। আমি চাই নারীদের জন্য একটা অনলাইন বুটিক খুলতে। চাঁদনীর জন্য তো আমি অনেক কাপড় ডিজাইন করি। এবার সেটা অন্যদের জন্যও করতে চাই।”
ওর চোখে সেই আগ্রহ দেখে আমার নিজের জন্য গর্ব হলো। আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
“তোমার স্বপ্ন পূরণ করাই আমার লক্ষ্য। তুমি যা করবে, আমি তোমার পাশে থাকব।”
জান্নাত বলল,
“তোমার পাশে থাকলেই হবে না। নিজের অফিসের কম্পিউটার আমাকে কয়েক দিনের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। আর চাঁদনীকে খেয়াল রাখতে হবে। পারবে?”
আমি মজা করে বললাম,
“চাঁদনী আমার মেয়ে। ওকে খেয়াল রাখা কোনো কঠিন কাজ না। কিন্তু তোমার জন্য অফিস ছেড়ে দেওয়া? এইটা একটু কঠিন!”
জান্নাত তখন আমার হাত ধরে বলল,
“তাহলে কিছুদিন কাজের ছেলে ডেকে আনো। আমি ওকে সামলে নেব।”
আমি হেসে বললাম,
“তুমি আর চাঁদনী মিলে আমাকে পুরোপুরি বাসার ম্যানেজার বানিয়ে ছাড়বে।”
জান্নাতের বুটিক শুরু হলো। তবে প্রথম অর্ডারই এলো এমন একজনের কাছ থেকে, যার নাম শুনে আমি চমকে গেলাম। সেটা ছিল জান্নাতের পুরনো বন্ধু পনি।
পনি বলেছিল,
“আমি সবসময় জান্নাতকে বলতাম, ওর প্রতিভা অনেক বড়। আজ সেটাই প্রমাণ হলো।”
জান্নাত পনির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হ্যাঁ দোস্ত, প্রতিভা বড় কথা না। পাশে একজন সাপোর্টিভ মানুষ থাকাটা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।”
পনি একটু হেসে আমার দিকে তাকাল। আমি লজ্জায় মাথা চুলকাতে লাগলাম।
জান্নাত তখন বলল,
“ওই, তুমি এত চুপ কেন? কালকে কিন্তু চাঁদনীর স্কুলে বাবা-মা মিটিং। আর হ্যাঁ, পারলে নিজের জন্যও একটা গিফট কিনে নিয়ে আসবে। কারণ পরশু তোমার জন্মদিন। কিন্তু আমি তো তোমাকে সারপ্রাইজ দিবই!”
এভাবেই আমাদের জীবন চলতে থাকে। প্রতিদিন ঝগড়া, রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার মিশেলে জীবন যেন একটা রঙিন সিনেমার মতো কাটছে।