অন্তিমের গল্পটি যেন ভালোবাসার এক নীরব সুর, যেখানে শব্দ কম, কিন্তু অনুভূতি গভীর। এই গল্পটিকে আরও মানবিক ও রোমান্টিক করে সহজ ভাষায় লিখলাম—
অন্তিম প্রতিদিনের মতো কম্পিউটার ক্লাসে গিয়ে নিজের ছোট ছোট অনুভূতির কথা নোটপ্যাডে লিখে রাখত। তার লেখা ছিল গভীর, সহজ কথায় মোড়ানো ভালোবাসার খোঁজ। তার নোটপ্যাডের একটি ফোল্ডারের নাম ছিল—”ভালোবাসার শেষ মৃত্তিকায়”। সেখানে লেখা ছিল—
“সেই মেয়েটাকেই ভালোবাসবো… যে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে পারবে, যতক্ষণ না তার কাজল ভিজে গলে পড়ে।”
এই লেখাগুলো অন্তিমের জন্য ছিল একরকম ব্যক্তিগত ডায়েরি, যেখানে সে নিজের মনের কথা লুকিয়ে রাখত।
একদিন ক্লাস শেষে বের হওয়ার সময় অন্তিম লক্ষ্য করে, সাদা ড্রেস পরা এক মেয়ে ক্লাসের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। অন্তিম চোখের আড়াল করেও বুঝতে পারল, মেয়েটির চোখে যেন লুকিয়ে থাকা কোনো কথা আছে। কিন্তু সে কিছু না ভেবে সেদিন বাড়ি ফিরে যায়।
পরের দিন ক্লাসে গিয়ে ট্রেইনারের থেকে জানতে পারে, মেয়েটির নাম অনন্যা—শান্ত স্বভাবের, ভদ্র। কিন্তু অন্তিমের কৌতূহল বাড়তেই থাকে। সে কম্পিউটারে অনন্যার নামে সার্চ করে, এবং অবাক হয়ে দেখে অনন্যারও একটি ফোল্ডার আছে। সেখানে অন্তিমের নোটপ্যাডের লেখাগুলোর জবাব লেখা!
একটিতে লেখা ছিল—
“সেই ছেলেটির অপেক্ষায় আছি… যে আমার কান্না ভেজা চোখের কাজল নিজের হাতে মুছে দেবে।”
অন্তিমের মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে। এ যেন অদেখা-অচেনা এক অনুভূতির সুতো, যা দুজনের মধ্যে বিনা কথায় জড়িয়ে গেছে। এরপর শুরু হয় তাদের এক অদ্ভুত ভালোবাসার খেলা—ডিজিটাল চিঠির বিনিময়। ছয় মাস ধরে তারা এভাবে কথা বলে, ফোন নম্বরও বিনিময় হয়, কিন্তু অনন্যা এখনো জানে না অন্তিমই সেই ছেলেটি।
অবশেষে সিদ্ধান্ত হয় দেখা করবে। অনন্যা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। অন্তিম ইচ্ছা করেই একটু দেরি করে। অনন্যা অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত, মন খারাপ করে কান্না ধরে রাখতে পারে না। তখনই অন্তিম বাইক নিয়ে তার সামনে আসে।
অন্তিম বলে, “আপনি অনন্যা তো? কারও জন্য অপেক্ষা করছেন?”
অনন্যা অবাক হয়, ভাবে—এই ছেলেটি কি তবে সেই ‘লুকোচুরি পাগল’? কিন্তু চিনতে পারে না। মন খারাপ করে বলে, “হ্যাঁ, অপেক্ষা করছিলাম। হয়তো সে আসবে না।”
অন্তিম তখন অনন্যার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, “তবে কি আপনি অন্ধ? আমি তো আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি!”
অনন্যা তখন চমকে উঠে, তাকিয়ে থাকে। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে। অন্তিম হাসতে হাসতে অনন্যাকে নিজের দিকে টেনে নেয়, আলতো করে তার কাজল ভেজা চোখের জল মুছে দেয়, ঠিক সেইভাবে যেমন তারা দু’জন নোটপ্যাডে লিখেছিল।
অনন্যা কান্নার ভেতরেও হেসে ফেলে, অন্তিমের বুকে মুখ লুকিয়ে ফেলে। অন্তিম শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তার “ভালোবাসার কাজল কন্যা”কে।
সেই দিন তাদের নীরব কথাগুলো প্রাণ পায়। ভালোবাসা আর কান্না মিলেমিশে এক হয়। যেটা শুধু কথায় নয়, অনুভূতিতে গাঁথা হয়ে থাকে চিরদিনের জন্য।
অন্তিম আর অনন্যার ভালোবাসার গল্পটা যেন এক অসম্পূর্ণ কবিতা, যার শেষ লাইনটি তখনও লেখা হয়নি। সেই দিনের পর তাদের জীবনে আসে এক নতুন সূচনা। কাজল ভেজা চোখের কান্না আর অন্তিমের উষ্ণ আলিঙ্গনের মধ্যে তৈরি হয় অদ্ভুত এক বন্ধন।
দিনগুলো সুন্দরভাবে কাটতে থাকে। তারা একসাথে ঘুরতে যায়, রোদেলা দুপুরে কফির কাপে ভাগাভাগি করে স্বপ্ন, আর রাতের নির্জনতায় ফোনে ফিসফিস করে মনের কথাগুলো। অন্তিমের নোটপ্যাড আর অনন্যার ডিজিটাল চিঠি এবার রূপ নেয় বাস্তব কথোপকথনে। কিন্তু ভালোবাসার গল্প কি এত সহজেই শেষ হয়?
একদিন অন্তিমের জীবনে আসে এক নতুন চ্যালেঞ্জ। তার একটি বড় চাকরির অফার আসে অন্য শহরে। স্বপ্নের সুযোগ, কিন্তু তার মানে অনন্যার থেকে দূরে থাকা।
অন্তিম খবরটা অনন্যাকে জানাতে ভয় পায়। শেষ পর্যন্ত একদিন তারা নদীর ধারে বসে, যেখানে অন্তিম বলল, “অনন্যা, একটা কথা আছে।”
অনন্যা হেসে বলে, “এই যে গম্ভীর মুখ, আবার কি কোনো চমক?”
অন্তিমের চোখে লুকানো কষ্ট দেখে অনন্যা বুঝে ফেলে, কিছু একটা আছে। “আমি অন্য শহরে যেতে পারি… হয়তো বেশ কিছুদিনের জন্য,” অন্তিম ধীরে ধীরে বলে।
অনন্যার চোখে জল চলে আসে, তবে এবার সেই জল কাজল ভেজানোর জন্য নয়, বরং অন্তিমকে শক্ত করে ধরার জন্য।
“তুমি কি জানো, অন্তিম?” অনন্যা কাঁপা গলায় বলে, “তোমাকে হারানোর ভয় আমার নেই। কারণ তুমি আমার হৃদয়ে আছো, নোটপ্যাডে নয়। তুমি দূরে থাকলেও আমাদের ভালোবাসা কোনো কম্পিউটার ফোল্ডারে আটকে থাকবে না।”
অন্তিম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটা তো তাকে ভালোবাসার নতুন মানে শিখিয়ে দিল।
বছর খানেক পেরিয়ে যায়। অন্তিম নতুন শহরে ব্যস্ত, অনন্যা তার পড়াশোনা শেষ করে নিজেও একটি ভালো চাকরি পায়। তারা দূরে থেকেও প্রতিদিন কথা বলে, সেই একই অনুভূতি নিয়ে।
একদিন অন্তিম হঠাৎ করে শহরে ফিরে আসে, কিন্তু অনন্যাকে জানায় না। সে যায় সেই পুরোনো কম্পিউটার ক্লাসে, যেখানে তাদের ভালোবাসার যাত্রা শুরু হয়েছিল।
অনন্যা তখন ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে, হয়তো কারও জন্য অপেক্ষা করছে। অন্তিম ধীরে ধীরে তার পেছনে গিয়ে ফিসফিস করে, “এই যে, কাজল কন্যা, আবার কাঁদবে নাকি?”
অনন্যা পিছনে ফিরে তাকিয়ে কিছু বলে না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, কিন্তু এবার কোনো বেদনায় নয়—এটা খুশির কান্না।
অন্তিম তার দুই হাত দিয়ে অনন্যার চোখের জল মুছে দেয়, হাসতে হাসতে বলে, “এইবার কাজল ভিজে যেতে দিও না, কারণ আমি আর দূরে যাচ্ছি না। আমি ফিরে এসেছি, চিরদিনের জন্য।”
অনন্যা কোনো কথা না বলে অন্তিমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
এইবার আর কোনো নোটপ্যাডের দরকার হয় না। তাদের গল্পটা এবার কাগজে নয়, হৃদয়ে লেখা হয়ে যায়—চিরদিনের জন্য।