সন্ধ্যার ছায়া নেমেছে শহরের রাস্তায়। ব্যস্ত রাস্তার মাঝে এক তরুণী দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটছে, তার চোখে রাগের আগুন। পেছন থেকে পা মিলিয়ে চলছে এক তরুণ, যেন কিছু বলবে কিন্তু দ্বিধায় পড়ে যায়। অবশেষে, তরুণী হঠাৎ থেমে দাঁড়ায় এবং ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে—
—এভাবে আমার পিছু নিচ্ছেন কেন? (মেয়েটি রাগে ফুঁসতে থাকে)
—কাকে বলছেন? (ছেলেটি কপট বিস্ময় দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে)
—এখানে আপনাকে ছাড়া আর কাউকে দেখছি না!
—নাহ! আপনি একটু থামুন।
—কেন থামবো?
—আমি আপনার সামনে যাবো, তাহলে আর আপনার পিছু নিতে হবে না। (ছেলেটি মৃদু হাসে)
—আপনার সাহস তো কম নয়! (মেয়েটির চোখে সন্দেহ)
—আমি আপনার খাই না পরি যে আপনি যা বলবেন তাই শুনতে হবে? (ছেলেটি গম্ভীর হয়ে যায়)
—তা আপনি আমায় খাওয়ান না পরান? রাস্তা কি আপনার বাবার?
—অসভ্য, সুন্দরী মেয়ে দেখলেই পিছু নেয় ছেলেরা!
—হ্যালো, কে বলল আমি সুন্দরী? আয়নায় মুখ দেখেছেন? আমার পাড়ার জরিনাও আপনার চেয়ে ভালো দেখতে!
দুজনেই ক্রমশ রেগে যায়, কথার ঝাঁঝ বাড়তে থাকে। কিন্তু কারও মুখে হাসি চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল।
দুজনেই গন্তব্যের পথে এগিয়ে যায়, একে অপরকে এড়িয়ে চলতে চায়, কিন্তু ভাগ্য যেন ঠিক করে রেখেছিল অন্য কিছু। কিছুক্ষণ হাঁটার পর, দুজনেই একই রেস্তোরাঁয় প্রবেশ করে।
মেয়েটি বসে অর্ডার দেয়— “এক প্লেট ফুচকা দিন!”
ছেলেটি পাশের টেবিলে বসে বলে— “আমাকেও এক প্লেট ফুচকা দিন!”
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে তাকায়— “আপনার কি একদমই নিজের পছন্দ নেই?”
ছেলেটি মুচকি হেসে বলে— “ঠিক আছে, আমিও এক কাপ কফি নেব!”
মেয়েটি বিরক্ত হয়ে চোখ বড় করে তাকায়, তারপর ফোন বের করে কাউকে কল দেয়। অবাক করার মতো ব্যাপার ঘটে— ছেলেটির ফোন বেজে ওঠে! দুজনেই অবাক হয়ে তাকায়।
—আপনি এখানে কেন? (মেয়েটি হতভম্ব)
—আপনিই বা এখানে কেন? যার আসার কথা, সে এলো না কেন? (ছেলেটি অবাক)
—মানে?
—আমি যার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি, সে আপনার মতো বদমেজাজী নয়!
—হ্যালো, মুখ সামলে কথা বলুন!
ততক্ষণে দুজনেই বুঝতে পারে, তারা পরস্পরের সঙ্গে অনলাইনে কথা বলছিল, পরিচয় গোপন রেখে।
এই ঘটনার পরেও দুজনের মধ্যে রাগ-ঝগড়া চলতে থাকে, কিন্তু মনে মনে তারা একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে।
একদিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছেলেটি দেখে মেয়েটি গান গাইছে। তার কণ্ঠের মায়ায় যেন ছেলেটি হারিয়ে যায়। এতদিনের রাগ-ঝগড়া ভুলে যায় সে। গান শেষ হওয়ার পর, ছেলেটি এগিয়ে এসে বলে—
—তুমি এত সুন্দর গান গাও! আগে জানতাম না।
—তোমার জানার প্রয়োজন ছিল না। (মেয়েটি মুখ ফিরিয়ে নেয়)
—কিন্তু এখন তো জেনে গেছি। আমি চাই, তুমি আমার জীবনের গান হয়ে যাও।
মেয়েটি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলে—
—তুমি কি সত্যি বলতে চাও? নাকি শুধু ঝগড়ার প্রতিশোধ নিতে চাও?
—আমি আমার মনের কথা বলছি। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মেয়েটি একটুখানি হেসে বলে—
—তাহলে একটা কথা দাও, তুমি আমাকে কখনো একা ছেড়ে যাবে না।
ছেলেটি তার হাত ধরে বলে—
—তোমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না। তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায়।
সেদিনের মতো আর কোনো ঝগড়া হয়নি। শুধু হৃদয়ের নীরব ভাষা তাদের মিলিয়ে দিলো চিরকালের জন্য। ❤️
অয়ন আর আদিবার প্রেম যেন এক নতুন রঙিন গল্পের সূচনা করল। ওদের মধ্যে ঝগড়া তো আগেও ছিল, কিন্তু এখন সেই ঝগড়ার মাঝেও এক ধরনের মিষ্টি রোমান্স লুকিয়ে থাকে। একে অপরকে টিজ করা, রাগ দেখানো, আবার একটু পরেই নিজে থেকেই মানিয়ে নেওয়া—এটাই যেন ওদের ভালোবাসার ভাষা হয়ে উঠেছে।
একদিন বিকেলে, ক্যাম্পাসের পাশের সেই পরিচিত রেস্তোরাঁয় বসে আদিবা আর অয়ন গল্প করছিল। হঠাৎ আদিবা একগাল হেসে বলল,
— “বলো তো, আমি যদি হুট করে উধাও হয়ে যাই, তুমি কি করতে?”
অয়ন হাসতে হাসতে বলল,
— “কোথায় যাবে? তোমার মতন ঝগড়াটে মেয়েকে তো আর কেউ পাবে না!”
— “ধুর! সিরিয়াসলি বলছি। ধরো, আমি যদি বিদেশ চলে যাই, কিংবা…”
— “না! এই নিয়ে কোনো কথা হবে না। তুমি আমায় ছাড়া কোথাও যাবে না!”
অয়ন হুট করে আদিবার হাত চেপে ধরল। আদিবা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারল, ছেলেটা ওকে হারানোর ভয় পাচ্ছে।
— “বোকা, আমি তো মজা করছিলাম! তবে যদি সত্যি কিছু করতে হয়, তাহলে আগে ক্যারিয়ার গড়তে হবে, বুঝেছ?”
অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— “হুম, সেটাই তো। তোমার বাবা-মা যদি আমাদের সম্পর্ক মেনে না নেয়?”
আদিবা চুপ হয়ে গেল।
ও জানত, ওর পরিবার খুবই রক্ষণশীল। ওরা কখনো চায় না মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করুক। আর অয়নের তো লেখালেখির প্যাশন থাকলেও, ও এখনো আর্থিকভাবে তেমন শক্ত অবস্থানে নেই।
— “আমাদের লড়তে হবে, একসাথে।”
— “কিন্তু কিভাবে?”
— “প্রথমত, তুমি তোমার ক্যারিয়ারের দিকে মন দাও। আমি আমার লেখালেখিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাব। তারপর আমি তোমার বাবার সামনে গিয়ে বলব, ‘আমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসি, আর ওকেও ভালো রাখতে পারব।'”
আদিবা একটু হেসে বলল,
— “বড় কথা বলছো তো! সত্যি করে দেখাও দেখি।”
— “চ্যালেঞ্জ?”
— “চ্যালেঞ্জ!”
অয়ন এখন আরও বেশি পরিশ্রম শুরু করল। ওর গল্পগুলো এখন দেশের বড় বড় পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে। ওর প্রথম বই প্রকাশিত হওয়ার খবর শুনে আদিবা তো খুশিতে আত্মহারা!
— “তুমি পারবে, অয়ন!”
— “আমরা পারব, আদিবা!”
ওদের স্বপ্ন ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকল।
এদিকে আদিবা নিজেও ক্যারিয়ারের জন্য অনেক পরিশ্রম করতে লাগল। ওর ইচ্ছা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থী হওয়া, যাতে বাবার সামনে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার শক্তি অর্জন করতে পারে।
সবকিছু ঠিক চলছিল, কিন্তু একদিন বড় একটা ধাক্কা এলো।
আদিবার বাবা ওর জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এলেন।
— “তোর জন্য একটা ভালো পাত্র ঠিক করেছি। সরকারি চাকরি করে, পরিবারও সম্মানিত। এই মাসের মধ্যেই এনগেজমেন্ট হবে।”
আদিবা শক খেয়ে গেল।
— “বাবা, কিন্তু…”
— “কিন্তু-টিন্তু কিছু না! আমরা যা ঠিক করেছি, সেটাই হবে!”
সেই রাতে ও অয়নের সাথে দেখা করল।
— “অয়ন, আমরা কি পারব?”
— “পারতে হবে, আদিবা!”
— “কিন্তু বাবা খুব জেদি।”
— “তাহলে আমাদেরকেও জেদি হতে হবে!”
ওরা দুজন মিলে একটা প্ল্যান করল।
সেই প্রস্তাবিত পাত্রের সাথে এনগেজমেন্টের দিন ঠিক হলো।
কিন্তু বিয়ের একদিন আগে, আদিবার বাবা হঠাৎ ওর রুমে এসে দেখলেন, বিছানার উপর একটা চিঠি রাখা।
“বাবা, আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাই না। কিন্তু আমি কাউকে ভালোবাসি, যে আমাকে সত্যিই বোঝে। আপনি যদি আমাকে সত্যি ভালোবাসেন, তাহলে আমার সিদ্ধান্তকে সম্মান করুন।”
আদিবার বাবা হঠাৎ করেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন। ওর মাকে ডেকে বললেন,
— “আমাদের মেয়েটা এখন বড় হয়েছে। ওর নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।”
তারপর ফোন দিলেন আদিবাকে,
— “যাকে ভালোবাসিস, তাকে নিয়ে আয়। দেখা করব।”
এই কথা শুনেই আদিবা দৌড়ে গিয়ে অয়নের কাঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
— “আমরা জিতেছি, অয়ন!”
— “তুমি বলেছিলে না, একসাথে লড়তে হবে? দেখো, আমরা পেরেছি!”
এরপর অয়ন আর আদিবার বিয়ে হলো এক বছর পর, যখন অয়ন দেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হয়ে উঠল, আর আদিবা নিজের ক্যারিয়ারে প্রতিষ্ঠিত হলো।
ওদের সম্পর্ক ঝগড়া দিয়ে শুরু হলেও, ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণতা পেল।
💖 শেষ, কিন্তু ভালোবাসার গল্প চলবে… 💖