রাত ন’টা বাজে। শহরের ব্যস্ততা একটু কমেছে, কিন্তু আমার মনের ভিতর উত্তেজনা আর দ্বিধার লড়াই চলছে। হাতে একটা ছোট্ট শপিং ব্যাগ, ভিতরে একটা জামা। মুন্নির জন্য।
কাল রাতে ফোন করেছিলো পাগলিটা—
“ভাইয়া, এইবার ঈদে বাড়ি আসবি না?”
“না রে আপু, তোর কিছু লাগবে?”
“ভাইয়া, পাশের বাড়ির মেয়েটা একটা নতুন জামা নিয়েছে… আমাকে একটা কিনে দিবি?”
তারপর শুরু হলো ওর চাওয়া জামার বিস্তারিত বর্ণনা। মনে হলো, মনে মনে সে কতদিন ধরে এই জামাটা চেয়েছিল! অথচ কখনও কিছু বলেনি।
আমি থাকি শহরে, টিউশনি করে কোনোরকমে টিকে আছি। গ্রামের বাড়িতে মা আর ছোট বোন মুন্নি থাকে। বাবা চলে যাওয়ার পর মা মানুষের বাসায় কাজ করে আমাদের মানুষ করেছেন। এখন মুন্নি এসএসসি দেবে। ওর একটা ইচ্ছা পূরণ করতে না পারলে আমি কেমন ভাই?
জামাটা কিনলাম, দাম ৩০০০ টাকা! পুরো মাসের খরচ প্রায় শেষ, কিন্তু তাতে কী? মুন্নির হাসিটা দেখার জন্য সব কিছু জলাঞ্জলি দেওয়া যায়।
জামাটা কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিয়ে মেসে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণ পরেই বড় ভাই এসে বললো—
“এই মাসের ভাড়া?”
পকেটে তখন মাত্র ৩০০ টাকা। মাথা নিচু করে থাকলাম। বড় ভাই বুঝতে পারলো—
“নীল, এইভাবে কতদিন চলবি? যদি মনে করিস, মেস ছেড়ে দিতে পারিস… অর্ধেক টাকা মাফ করে দেবো।”
একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত—আমি আর এখানে থাকতে পারবো না।
সকালে ফোন এলো। নীলু!
“এইমাত্র তোর মেসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সব কিছু নিয়ে বের হ।”
“মানে?”
“আগে বের হ, তারপর বুঝবি!”
রিকশায় বসে নীলুর চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, মেয়েটা রেগে আছে।
“তুই বললি তুই গ্রামে? তাহলে এখানে কেন?”
কোনো উত্তর নেই আমার কাছে।
“সোহানের কাছ থেকে সব শুনেছি, তোর টাকা ছিল না, তাই গ্রামে যেতে পারিসনি। মেসেও সমস্যা হয়েছে। কেন আমায় বলিসনি?”
আমি মাথা নিচু করলাম।
“আজ থেকে তুই আর মেসে থাকবি না।”
আমাকে একটা বাসায় নিয়ে গেলো। সুন্দর একটা ফ্ল্যাট।
“এই বাসায় থাকবি, মাসে মাসে ভাড়া দিবি, রান্না আমি করে দিয়ে যাবো!”
“কিন্তু…”
“চুপ! চাকরিটাও ঠিক করে দিয়েছি। মাসে ২২,০০০ টাকা পাবি। ১০,০০০ গ্রামে পাঠাবি, ৪,০০০ বাসার ভাড়া, ৬,০০০ তোর খরচ। আর বাকি ২,০০০ টাকায় প্রতি মাসে আমায় লাল চুড়ি কিনে দিবি!”
নীলু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে বললো—
“করো না বাবু, চাকরিটা তোমার জন্য না হলেও, তোমার মা আর বোনের জন্য করো।”
আমি ওর হাত ধরে বললাম—
“পারবো!”
নীলু হাসলো। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
সত্যিই, কিছু হাসি থাকে যা শুধু দেখা যায় না, অনুভবও করা যায়। ❤️
এই গল্পে আমি নীলুর ভালোবাসাকে আরও দৃঢ় করেছি, মুন্নির প্রতি ভাইয়ের আত্মত্যাগের অনুভূতি বাড়িয়েছি এবং সংলাপগুলোকে আরও স্বাভাবিক ও আবেগপূর্ণ করেছি। আশা করি, তোমার ভালো লেগেছে! 😊
নীলুর দেওয়া বাসাটায় উঠে আসার পর থেকেই সবকিছু বদলে গেলো। জীবন যেন একটু সহজ হয়ে এলো।
কিন্তু একটা অপরাধবোধ সবসময় কুরে কুরে খাচ্ছে আমাকে—আমি কি নীলুর এই ভালোবাসার যোগ্য? ও এত কিছু করছে আমার জন্য, কিন্তু আমি ওর জন্য কী করেছি?
নীলু প্রতিদিন সকালে নাশতা করে দিয়ে যায়। কাজ থেকে ফিরে এসে রান্না করে দিয়ে যায়। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখার বাহানা করে আমাকে বাইরে টেনে নিয়ে যায়। ওর চাওয়াগুলো খুব ছোট ছোট, কিন্তু এত গভীর যে আমি না বলতে পারি না।
একদিন রাতে নীলু এলো। হাতে একটা কেক।
“এই নে, তোর নতুন চাকরির সেলিব্রেশন!”
আমি অবাক হয়ে বললাম—
“নীলু, এটা কি দরকার ছিল?”
ও চোখ গোল করে বললো—
“তোর তো দরকার ছিল, পাগলটা!”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটা এত সহজভাবে আমাকে ভালোবাসে, অথচ আমি একবারও ওকে বলিনি যে আমিও ওকে ভালোবাসি!
সেদিন রাতে মা ফোন করলেন।
“বাবা, মুন্নির জন্য একটা ভালো কলেজ খুঁজে দেখ। ওর রেজাল্ট ভালো হয়েছে। আমি চাই না ও আমার মতো মানুষের বাসায় কাজ করুক।”
মায়ের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস আর আশা। কিন্তু আমার মনে ভয়। টাকার চিন্তা। কলেজে ভর্তি, নতুন বই, থাকার খরচ—সব মিলে অনেক টাকা লাগবে।
নীলুকে বললে ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করবে। কিন্তু আমি আর ওর কাছে কিছু চাইতে পারবো না!
রাতে ঘুম আসলো না।
পরদিন অফিস থেকে বের হয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। একটা পার্টটাইম টিউশনি পেলাম, রাতে পড়াতে হবে।
নীলুকে বললাম না।
সপ্তাহখানেক পর…
রাতে টিউশন শেষ করে বাসায় ফিরছি। দরজা খুলতেই দেখি, নীলু বসে আছে। হাতে খাবারের ব্যাগ। মুখটা গম্ভীর।
“তোর কাছে আমি কি? শুধুই একজন বন্ধু?”
আমি চমকে গেলাম—
“কেন বলছো এসব?”
“তাহলে কেন বলিসনি তুই আবার টিউশনি নিচ্ছিস? কেন এত লুকোছিস?”
আমি মাথা নিচু করলাম।
“আমি চাই না তোর কষ্ট হোক, নীলু।”
নীলু ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো।
“তুই বুঝিস না? তুই কষ্ট পেলে আমারও কষ্ট হয়। আমি শুধু চাই তুই সুখে থাক।”
আমি ধীরে ধীরে ওর কাছে গেলাম। ওর হাতটা ধরলাম।
“নীলু, আমি শুধু একটা কথা জানি—তুই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। আমি হয়তো তোর যোগ্য না, কিন্তু তোকে ছাড়া আমার জীবন কল্পনা করতে পারি না।”
নীলু চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর ধীরে ধীরে হাসলো।
“তাহলে প্রপোজ করবি না?”
আমি অবাক হয়ে বললাম—
“মানে?”
“ঠিক সিনেমার মতো, একটা সুন্দর প্রপোজাল চাই। নাহলে আমি কিন্তু রাগ করবো!”
আমি হাসলাম। তারপর হাতটা ওর হাতে রেখে বললাম—
“নীলু, এই জীবনে তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। যদি তুই আমায় গ্রহণ করিস, তাহলে আমি প্রতিদিন তোকে নতুন নতুন গল্প শুনিয়ে ঘুম পাড়াবো, লাল চুড়ি কিনে দিবো, আর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোকে ভালোবাসবো!”
নীলু হেসে বললো—
“লাল চুড়ির ব্যাপারটা ভালো বলছিস! তাইলে এবার আমাকে একটা লাল চুড়ি কিনে দে, আমি হ্যাঁ বলে দিচ্ছি!”
আমি হেসে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
আমার জীবনের সব সুখ এক ফ্রেমে বন্দি হয়ে গেলো।