তাওহীদ প্রতিদিনের মতো সাইকেল নিয়ে বের হলো, আর মায়ের কাছে বলে গেল, “মা, সন্ধ্যার পর ফিরব।” এটাই তার নিয়ম। আবার ফিরেও এসে একইভাবে বলে, “মা, আমি ফিরেছি,” আর তারপর সোজা রুমে চলে যায়।
সেদিনও তাওহীদ বের হয়, কিন্তু গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করতে থাকে, কোথায় যাবে। ঠিক তখনই পেছন থেকে একটি সাইকেল এসে তার সাইকেলে ধাক্কা দেয়। তাওহীদ সাইকেলসহ রাস্তায় পড়ে যায়। পেছনে তাকাতেই দেখে, একটি মেয়ে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি মনে মনে বলছে, “আমি ইচ্ছা করে করিনি।”
তাওহীদ রাগে ফেটে পড়ে, “এই যে মিস কানি, আপনি কি সামনে কিছু দেখতে পান না?” মেয়েটি চশমা ঠিক করে উত্তর দেয়, “আমি কানি নই। আর আড়ালে থাকলে কীভাবে দেখব?”
তাওহীদ বিরক্ত হয়ে বলে, “মেয়েদের আমি ভালো করেই চিনি। ভ্যাংচি মারার কী দরকার! মুখ কি শুধু আপনারই আছে?”
মেয়েটি চুপ করে থাকে, কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, “এই ছেলেকে আমি সহজে ছাড়ব না। যেখানে পাব, সেখানেই শাস্তি দেব।”
এই মেয়ে সাথী। সাথী সম্প্রতি তাদের নতুন প্রতিবেশী হয়েছে। তাওহীদ ও সাথী কেউই জানে না যে তারা এক বাড়িতে থাকে।
তাওহীদ শান্ত ও ভদ্র ছেলে হলেও খুব রাগী। এইচএসসি পরীক্ষার জন্য সে ব্যস্ত। অন্যদিকে, সাথী সদ্য এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। সে দুষ্টু, কিন্তু মনটা সাদা কাগজের মতো।
ধাক্কা দেওয়ার সেই ঘটনার পর সাথী প্রতিদিন বিকেলে বের হয় এবং তাওহীদের খোঁজ করে। যখনই তাকে দেখে, ইচ্ছে করে সাইকেলসহ তাকে ফেলে দেয়। তাদের ঝগড়া যেন থামতেই চায় না। পার্কে দেখা হলেও, তাওহীদ আর সাথীর ঝগড়ার নতুন উপাখ্যান শুরু হয়।
তাওহীদ এতো বিরক্ত হয় যে বাসা থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দেয়। সময় কাটাতে সে ছাদে যেতে শুরু করে। কিন্তু সাথী কি এত সহজে তাকে ছেড়ে দেবে?
একদিন সাথী ছাদে গিয়ে তাওহীদের সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হাসে। তাওহীদ বিরক্ত হয়ে বলে, “মিস কানি, আপনি এখানেও চলে এসেছেন?”
সাথী ঠাট্টা করে বলে, “আপনার গালি না শুনলে দিন কাটে না।”
তাওহীদ রাগে ফেটে বলে, “আমার পরীক্ষা সামনে। আপনার ঝগড়ার কারণে ঠিকমতো পড়াশোনা করতে পারছি না।”
সাথী মুচকি হেসে বলে, “মিষ্টি করে কথা বললেই তো সব সহজ হয়ে যেত।”
তাওহীদ বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনার সঙ্গে আর ঝগড়া করব না। সামনে আসার চেষ্টা করবেন না।”
সাথী মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, “চান্দু, তোমাকে ছাড়ব না। একদিন তোমার মনের কথা বের করবই।”
সাথীর দুষ্টামি আর ভালোবাসা মিলে তার মনে এমন জায়গা তৈরি করে যে, তাওহীদের ঘুমের মধ্যেও সাথীর মুখ ভেসে ওঠে।
একদিন সাথী ইচ্ছে করেই তাওহীদের সাইকেলে ধাক্কা দেয়। কিন্তু এবার তাওহীদ পড়ে গিয়ে হাতে গুরুতর ব্যথা পায়। ডাক্তার জানায়, তার হাত ভেঙে গেছে।
সাথী রাতে জানে, তার ধাক্কায় তাওহীদের হাত ভেঙেছে। সে নিজের বালিশ ভিজিয়ে কাঁদে। নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনায় ভেঙে পড়ে।
কিছুদিন পর তাওহীদের পরীক্ষা শেষ হয়। একদিন সাথী সাহস করে তাওহীদের কাছে গিয়ে বলে, “আমি দুঃখিত। ঐ দিনের জন্য আমি খুব লজ্জিত। আমি এমনটা চাইনি।”
তাওহীদ তার দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা স্বরে বলে, “তুমি কি জানো, তোমার জন্য আমার কত কষ্ট হয়েছে? তোমার সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় ছিলাম। তুমি কি একবারও আসতে পারতে না?”
সাথী কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি লজ্জায় আসিনি। আমি তো আপনাকে ভালোবাসি, কিন্তু বুঝাতে পারিনি।”
তাওহীদ মৃদু হাসে, সাথীর হাত ধরে, আর বলে, “তোমার এই অবুঝ ভালোবাসার জন্যই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। এখন থেকে তুমি আর আমার থেকে দূরে যাবে না।”
সাথী চোখ মুছে বলে, “তাহলে আমিও আর তোমার থেকে দূরে থাকব না।”
তারা দুজন নীল আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তাদের গল্পের এই নতুন অধ্যায় যেন ভালোবাসার নতুন সূচনা।
তাওহীদ আর সাথীর জীবনে যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। দুজনেই বুঝতে পারল যে তাদের সম্পর্ক আর আগের মতো সাধারণ দুষ্টামি আর ঝগড়ায় আটকে নেই। ভালোবাসা ধীরে ধীরে দুজনকে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছে, যেন তাদের জীবন একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জুড়ে গেছে।
সেদিন ছাদে দুজনের মধ্যকার আবেগঘন মুহূর্তের পর তাওহীদ আর সাথীর দেখা-সাক্ষাৎ বাড়তে লাগল। এখন আর ঝগড়া নয়, বরং গল্প, হাসি আর দুজনের ছোট ছোট স্বপ্ন ভাগ করে নেওয়ার সময় কাটত। কিন্তু জীবনের পথে সবকিছু কি সহজে মিলে যায়?
তাওহীদ নিজের পড়াশোনায় ফিরে গেল। তার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আর সামনে নতুন এক অধ্যায়—বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি। সাথীও আস্তে আস্তে নিজের এসএসসি পরীক্ষার পরে পড়াশোনার দিকে মন দিতে চেষ্টা করছিল। তাওহীদ প্রায়ই বলত,
“তোমার পড়াশোনা ঠিকমতো চালিয়ে যেতে হবে। ভালো রেজাল্ট করবে, বুঝলে?”
সাথী সবসময় মুচকি হেসে বলত,
“তোমার কথা যদি শুনি, তাহলে তো এভারেস্টও জয় করে ফেলব!”
কিন্তু তাওহীদ অনুভব করত, সাথীর হাসির আড়ালে একটা গভীর ভয় লুকিয়ে আছে। ওর মন খারাপ হলেও সে তা কখনো প্রকাশ করত না।
একদিন সন্ধ্যায়, তাওহীদ বাড়ি ফিরে দেখল সাথী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তাওহীদ তাকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
“কি ব্যাপার, এত চুপচাপ কেন? তুমি তো আজ ঝগড়া শুরু করবে বলে এসেছিলে!”
সাথী একটু গম্ভীর মুখে বলল,
“তোমার সাথে একটা কথা বলার ছিল।”
তাওহীদ তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল, সাথীর সেই মায়াভরা চোখগুলো যেন আজ অস্থির।
“কী হয়েছে, বলো?”
সাথী ধীরে ধীরে বলল,
“বাবা নতুন ট্রান্সফারে গেছেন। কিছুদিনের মধ্যে আমাদের অন্য শহরে চলে যেতে হবে।”
তাওহীদের মনে হলো, আকাশ যেন তার মাথার উপর ভেঙে পড়ল। সে কিছুক্ষণ নীরব রইল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“তুমি তো জানো, আমরা কেউ কাউকে হারাতে চাই না। দূরত্ব তো ভালোবাসাকে কমাতে পারে না।”
সাথী চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। সে বলল,
“তাওহীদ, আমি জানি। কিন্তু তোমার আর আমার জীবনে অনেক দায়িত্ব। আমরা কীভাবে…?”

তাওহীদ সাথীর হাত ধরে বলল,
“কিছুই বদলাবে না। তুমি তোমার জীবনে এগিয়ে যাবে, আমিও আমার। আমাদের ভালোবাসা আমাদের শক্তি দেবে। সময় যত কঠিনই হোক, আমরা একে অপরের অপেক্ষায় থাকব।”
সাথীদের চলে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে এল। সেদিন সাথী আর তাওহীদের দেখা হলো পার্কে। দুজনই জানত, আজকের এই বিদায় সহজ হবে না। কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়াই তারা একে অপরকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করল।
তাওহীদ সাথীর হাতে একটা ছোট্ট খাম দিল। বলল,
“যখন মন খুব খারাপ করবে, তখন এটা খুলে দেখো।”
সাথী খামটা হাতে নিয়ে বলল,
“এখনই খুলব না?”
তাওহীদ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“না। এটা তখন খুলবে, যখন খুব বেশি মন খারাপ করবে।”
বিদায়ের সময় তাওহীদ সাথীকে বলল,
“তুমি যেখানেই থাকো, আমাকে ভুলবে না, সাথী। তোমার স্বপ্নগুলো কখনো থামিয়ে দিও না।”
সাথী কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,
“তোমার মতো মানুষকে ভুলে থাকা কীভাবে সম্ভব? আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করব, তাওহীদ। যতদিন প্রয়োজন।”
সাথীদের চলে যাওয়ার পর তাওহীদ নিজের পড়াশোনায় মন দিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো, নিজের জীবনের লক্ষ্য পূরণের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে লাগল। কিন্তু তার প্রতিদিনের রুটিনের একটা অংশ ছিল—সাথীর দেওয়া ছোট্ট উপহারগুলো দেখা। তাদের ছোট ছোট স্মৃতিগুলো তাকে বেঁচে থাকার শক্তি দিত।
অন্যদিকে সাথীও নতুন শহরে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল। মাঝে মাঝে সে তাওহীদের দেওয়া খামটা খুলে দেখত। সেখানে ছিল তাওহীদের হাতে লেখা কয়েকটা লাইন—
“দূরত্ব মানে তুমি হারিয়ে যাবে না। দূরত্ব মানে আমি তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসব। আর একদিন, আমি তোমার সামনে দাঁড়িয়ে বলব—সব স্বপ্ন পূরণ করেছি। এবার শুধু তোমাকে নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাব।”
এই লাইনগুলো প্রতিবারই সাথীর মন ভালো করে দিত। সে নিজেও পড়াশোনায় মন দিল, তাওহীদের স্বপ্ন পূরণে নিজের জায়গা থেকে সমর্থন করার জন্য।
কয়েক বছর পর, তাওহীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছর। সে এখন একজন প্রতিভাবান ছাত্র, সবাই তাকে চিনে। সাথীও তার কলেজ শেষ করে অনার্সে ভর্তি হয়েছে।
একদিন তাওহীদ সাথীর ঠিকানায় চিঠি পাঠাল। সেখানে শুধু কয়েকটা শব্দ ছিল—
“তোমার অপেক্ষায় আছি, সাথী। তুমি কি প্রস্তুত?”
চিঠিটা পেয়ে সাথী মুচকি হেসে বলল,
“প্রস্তুত তো অনেক আগেই ছিলাম, তাওহীদ। এবার দেখা করার পালা।”
তাদের গল্পের পরবর্তী অধ্যায় কীভাবে শুরু হবে, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত—তাদের ভালোবাসা ছিল এমন এক সুর, যা সময়, দূরত্ব আর যেকোনো বাধা পেরিয়ে অটুট ছিল