আজ জয়ার বিয়ে , জয়াকে আমি অনেক ছোট থেকে চিনি, ও আর আমি সম্পূর্ণ উল্টো, এটা সোজা হলেও হতো কিন্তু বিধাতার লেখা কি আর করা যাই ।
জয়াকে আজ অব্ধি একটু সাজতে দেখিনি, ওর সাজগোজের প্রতি তেমন একটা ইচ্ছা নেই , কত করে বলতাম একটু সাজ দেখবি ভালোলাগবে, মেয়েমানুষ না সাজলে ভালোলাগে! ও কিন্তু আমার কথা শুনতো না ।
সেই জয়া আজ পার্লারে গত তিনঘন্টা ধরে সাজছে, বরপক্ষ থেকে এই আলিশান পার্লার এর খোঁজ দেয়া হয়েছে, বর সাহেব তার বৌ কে সৌন্দর্যের চূড়ায় বসিয়ে দেখতে চান।
আমাকে জয়া গত তিনঘন্টা আগেই বলেছিলো এসব শেষ হলে ম্যসেজ দিবে যেন আমি চলে আসি, শেষ ১৫ মিনিটে দেখা করতে আসবে, আমি তিন ঘন্টা আগেই চলে এসেছি। এই ভাবে জয়ার জন্য অপেক্ষা করার হয়তো আজই শেষ দিন। তাই শেষ অপেক্ষাটুকু করছি, কত অপেক্ষা করেছি মেয়েটার জন্যে, সব অপেক্ষারই রেশে থাকতো বিরক্তি, অনীহা। আজকের অপেক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দরতম অপেক্ষা, তবু পৃথিবীতে এমন অপেক্ষা কোনো প্রেমিকের জীবনে না আসুক।
জয়া দাঁড়িয়ে আছে, সিদুঁর লাল রঙা শাড়ি, সারা শরীর জুড়ে গয়না, ওর স্কিন টোনকে আড়াল করে ফুটে উঠেছে প্রাইমার কন্সিলার হাইলাইটার এর জাকজমক আয়োজন।
আমি বললাম, দেখেছিস কত বলতাম একটু সেজেগুজে থাক ভালোলাগবে দেখ কত সুন্দর লাগছে আজকে। মেয়েটা ঝাপটে এসে পরলো বুকের ওপর, শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো, ওর চোখের জলে ভিজে যাচ্ছে আমার জামাটা । আমি নিরেট দাঁড়িয়ে আছি, বুক পকেটের পঞ্চাশটাকা আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে এই বলে যে, তুমি এই মেয়েটাকে এই মূহুর্তে পালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মত ক্ষমতাধারী নও।
গুনে গুনে পনেরো মিনিট জয়া কান্না করলো, শেষ কথা বললো, আমি স্বপ্নই দেখে গেলাম তোর সাথে করা লাল নীল সংসার এর তার বাস্তবায়ন করতে পারলাম না। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, একটু সেজেছিস যা, নষ্ট করিস না।
জয়া কে যেন আমি আমার মতই কঠোর হওয়ার মন্ত্র শিখালাম, মেয়েটা শক্ত হয়ে উঠলো। মূহুর্তেই চোখের পানি মিশিয়ে হেসে ফেললো, এক ফাঁলি হাসি দিয়ে বিদায় নিলো।
তারপর, পাঁচটা বছর ঐ একই শহরে আমি হেঁটেছি, আমার চলন দ্রুত থেকে দ্রুত হয়েছে। আশেপাশের মানুষ বলে আমাকে দেখলেই নাকি মনে হয় আমি অনেক ব্যস্ত, বিদ্যুৎ এর গতিতে চলি এর কিছু কারণ আছে, সেদিনের পর থেকে আমার রাস্তায় বেরোলে কেমন অস্থির লাগে। অস্থির লাগে এই ভেবে যদি রাস্তায় জয়ার সাথে দেখা হয়ে যায়, কিংবা ধীর পায়ে হাঁটলে যদি এই রাস্তায় ওর সাথে কাটানো কোন সময় মনে পরে যায়।
এভাবেই পাঁচটা বছর কাটিয়েছি, জয়াকে দেখিনি একটাবার ও। চাকরি পেয়েছি কিছুদিন হলো, এবার আর দ্রুত হাঁটা হয় না আর, শহরটা দেখি গ্লাসের আড়ালে, হয়তো জয়াকেও খুঁজে ফিরি। চিন্তা করি আচ্ছা যদি আমি জয়ার থেকে পাঁচ বছর আগে জন্ম নিতাম তবে কি জয়া আমার সাথে ওর লাল নীল সংসার সাজাতে পারতো! এসব অদ্ভুত চিন্তাভাবনার সমাপ্তি ঘটে যখন ভাবি হয়তো জয়ার এখন একটা মেয়ে হয়েছে, বাচ্চাসামলাচ্ছে সংসার করছে কতশত দায়িত্ব।
অফিস থেকে ফিরতেই মা একদিন বললো, সব হলো এবার বিয়ে কর। বয়স তো কম হলো না, একটু শান্তিতে তোর সংসার দেখে মরতে দে।
আমার মৌনতা কে পুজি করে মা মেয়ে দেখছে, বুকপকেটে পঞ্চাশ টাকা থাকায় জয়ার হাত ছেড়ে দেয়া ছেলেটা, আজ অনেক বড়লোক পরিবারের ডাইনিং টেবিলে কিংবা সোফার আড্ডায় গল্পের অংশ হচ্ছে। প্রতিদিন মা কোথাথেকে যেন কাওকে না কাওকে জোগাড় করে আসবেই। আজ পরিবেশ চুপচাপ, হয়তো এত বার মানা করায় মা ক্ষুন্ন হয়েছ।
খানিকবাদে মা এসে বললো, বুঝলি আজ একটা বিধবা মেয়ের প্রপোজাল এসেছে এতবার না করতে করতে এখন এই হাল হয়েছে।
–বিধবা মেয়ে.!
–হ্যাঁ। বিয়ের একবছরের মাথায় স্বামী মারা গেছে, মেয়ে নাকি ভালোই। কিন্তু তারপর সে বিয়ে করতে চায়নি আর। তার বাবা অনেক অসুস্থ এখন হয়তো রাজি হয়েছে।
–হ্যাঁ, বিয়ে করা যায়।
–কি? তুই কেন বিধবা বিয়ে করবি!
–এর মাঝে কোনো কেন নেই। এই মেয়ে না হলে অন্য মেয়ে দেখো স্বামী মারা গেছে বা বাচ্চা আছে এমন।
–কী বলছিস তুই! এসব বাচ্চাসহ , বিধবা মেয়ে কেন দেকবো পাগল হয়েছিস তুই? আত্মীয়-স্বজন কী বলবে?
–ওদের নিয়ে চিন্তা করি না তুমি বললেই চলে।
সেদিন বিকালে আমরা মেয়ে দেখতে যাচ্ছি। জয়া মাঝেসাঝেই বলতো আমাকে তোরা যেদিন দেখতে আসবি সেদিন আমি এমন করবো অমন করবো, আজ আসলেই দেখতে যাচ্ছি তবে অন্য মানুষকে। জয়া জানলে হয়তো খুশি হতো! হয়তো নিশ্চিন্ত হতো এই ভেবে যে কেউ একজন আমাকে সামলানোর জন্য থাকবে। যেই রাস্তায় গাড়ি চলছে সেই রাস্তায় জয়ার জন্য এসেছি বহুবার। ওর বাড়িও এদিকেই। গাড়ি থামলো।
বাড়িটা তো জয়ারেই , ভেতরে জয়ার বাবা আলিশান কাউচটাতে বসে আছে, জয়ার মায়ের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে আছে। জয়ার ভাই এর বিয়ে হয়েছে, তাদের দাপট বেড়েছে হয়তো। জয়ার বাবার চোখ মুখ নত, আগের দাম্ভিকতা নেই। জয়ার ভাই বিদেশে থাকতো সে এবং তার বৌ আমাকে চেনেনা। আমাকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে জয়ার বাবা মায়ের সাথে, সম্মান দিয়ে কথা বলছে। আমি মনে মনে হাসছি উনি না জেনে এমন মানুষের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে যেই মানুষটা একদিন পকেটে টাকা না থাকায় এই আলিশান কাউচে বসে ওই গেটের বাইরের ব্যর্থ ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
সে যাক গে, আমি অপেক্ষা করছি। অপেক্ষা করছি মেয়েটার জন্য। জয়ার ভাই তার বৌ কে বললো, নিয়ে আসো ওকে।
আমি তাকিয়ে আছি, কে সেই মেয়ে.! জয়া কি !!!.!
কিছুক্ষন পরেই জয়া আসলো। সাজগোজ নেই সাধারণ সাদামাটা বেশেই কী দারুণ লাগছে । পাঁচটা বছর পর জয়া আমার সামনে, ও অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। জয়া যেন অনেক টা গল্প বলার আছে, এত মানুষের মাঝে বলে উঠতে পারছে না।
জয়ার ভাই বললো। যা ওকে নিয়ে ঘরে যা
আমি আর জয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। জয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। কোনো বাড়তি কথা অপচয় না করে চুপচাপ আমরা দাঁড়িয়ে আছি। মৌনতা ভেঙে বললাম, তোমার লাল নীল সংসারের স্বপ্ন পূরন করতে এসেছি।
–তুই জানিস?
–না জানি না কি হয়েছে। জানতাম না মেয়েটা তুই। শুধু শুনেছি বিয়ের এক বছরের মাথায় মেয়েটার স্বামী মারা গেছে।
–জানতে চাস না?
–জানার সময় পাবো, কিন্তু তোকে পাওয়ার সময়সীমা অল্প। রাজি হয়ে যা জয়া ।
–এই গেটটা থেকে ফিরিয়ে দিয়েছিলো, কেন ওদের ফিরিয়ে দিচ্ছিস না।
–জয়া এটা কোনো রিভেঞ্জ গেম না। বোঝার চেষ্টা কর সেদিন এসেছিলাম যার জন্য সে মুখ্য ছিলো, আজ ও সে ই মুখ্য। আমি মুখ্য মানুষটাকে কখনো ফেরাতে পারবো না ভালোবাসি তোকে।
আমাদের বিয়েটা সেদিনই হয়। আয়োজন আড়ম্বরপূর্ণ জাকজমক বিয়ে আমরা চাইনি। জয়া একটা সুতি শাড়ি পরেছে, কপালে টিপ খোপায় গাজড়া। দুই পরিবার মিলিয়ে পনেরো জন কাছের মানুষ এসেছে, যারা নিতান্তই ভালো মানুষ যাদের অভিযোগ থাকবে না মেয়ের সাজহীন বেশ নিয়ে, স্বামীর মৃত্যু নিয়ে, আমার এমন মেয়ে কে বিয়ে করা নিয়ে কিংবা আমাদের কোনো আয়োজন হীন বিয়ে নিয়ে।
তারপর জয়া লাল নীল সংসার এর আহ্লাদ আমি দেখি প্রতিনিয়ত। কল্পনাহীন একটা সংসার পেয়ে যাওয়াই অনেক খুশি ।
ছেলে মানুষের সুখ দুঃখ উভয়ের প্রকাশ ভঙ্গী হয় ক্ষীণ। পাঁচ বছর আগে পনেরো মিনিটের দেখায় জয়ার দুঃখ বোঝা গেছিলো আমারটা বোঝা যায়নি, আজ ওর সুখ বোঝা যায় আমার সুখ বোঝা যায় না।
পাঁচ বছর পরের জীবন
জয়া এখন আমার পাশে। পাঁচ বছর আগের সেই দিনগুলোর কথা মাঝে মাঝে আমাদের হাসায়, আবার কখনো চুপচাপ ভাবায়। আমাদের লাল নীল সংসার সত্যিই এক মিষ্টি বাস্তবতা। কিন্তু জীবন তো শুধু সুখ আর স্মৃতির মেলা নয়; বাস্তবতাগুলোও কখনো কখনো কাঁটা বিছিয়ে রাখে।
আমরা দু’জনই চাকরি করি, একটা মধ্যবিত্ত জীবন গড়ে তুলেছি। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে গড়িয়ে যায়। জয়া প্রতিদিন আমাকে অফিস থেকে ফেরার সময় জানলায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। আমার কাছে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য।
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে মনে হলো, জয়া হয়তো একা একা হাঁপিয়ে উঠছে। সংসারটা যতটা নিজের, ততটাই আমাদের দু’জনের। ঠিক করলাম, পরদিন ওকে একটা ছোট্ট চমক দেব।
পরদিন অফিস থেকে একটু আগে বের হলাম। একটা বেলুন, ছোট্ট কেক আর জয়ার পছন্দের একটা গোলাপি শাড়ি কিনে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে ঢুকতেই জয়া রান্নাঘরে কিছু করছিল। বললাম, “আজ একটু বসো তো! রান্না আমি করব।”
জয়া অবাক হয়ে বলল, “তোমার আবার রান্না জানা আছে?”
হাসতে হাসতে বললাম, “দেখেই তো বুঝতে পারবে।”
রান্নাঘরে ঢুকে কিছু একটা করলাম। খাওয়া শেষে ও খুব প্রশংসা করল, যদিও খাবারটা যে ঠিকমতো হয়নি সেটা আমার চেহারাই বলে দিচ্ছিল।
সেই রাতেই বললাম, “চলো, একটা ছোট্ট ছুটি নিই। কোথাও ঘুরতে যাই। কত দিন হলো তোমার মন খুলে কোথাও যাওয়া হয়নি।”
জয়া হেসে বলল, “তুমি সব কিছু ভেবেই রেখেছ, তাই না?” আমি বললাম, “তোমার সঙ্গে এই জীবনটা যতটা সুন্দর হতে পারে, সেটা নিয়ে ভাবি।”
মনে পড়ে যাওয়া সময়
আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীর আগের দিন, হঠাৎ করেই জয়ার পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ওর বন্ধুরা সবাই তখন খুব মজা করছিল। জয়া আমাকে দেখিয়ে বলল, “এ হচ্ছে আমার লাল নীল সংসারের আসল হিরো।”
ওদের এক বন্ধু বলল, “তোমরা তো সিনেমার গল্প হয়ে গেছো! এই গল্পটা সবাই জানলে অনেকের ভরসা ফিরে আসবে।”আমি হেসে বললাম, “আমাদের গল্পটা কোনো সিনেমার মতো হয়তো নয়। কিন্তু হ্যাঁ, ভালোবাসার গল্প।”
জীবনের গভীরতা

জয়া আর আমি এখন শুধু একে অপরের সঙ্গী নই, আমাদের গল্পের চরিত্রও। আমরা বুঝতে শিখেছি, ভালোবাসা কখনো শুধুই কবিতা আর রোম্যান্সের জন্য নয়, বরং দায়িত্ব, যত্ন, সমঝোতা আর একে অপরের পাশে থাকার জন্যও।
জয়া মাঝে মাঝে বলে, “তুই কী করে এত সহজে সব কিছু মেনে নিলি? আমি তো ভেবেছিলাম, আমার বিধবা হয়ে থাকা জীবনের শেষ অধ্যায় হবে।”
আমি তখন হাত ধরে বলি, “জয়া, তোর পাশে থাকতে পারার অনুভূতি আমাকে বদলে দিয়েছে। তুই যদি আমাকে ফের ভালোবাসতে পারিস, তাহলে কোনো কষ্টের কথা ভেবে আর কী হবে?”
জয়া হাসে। এই হাসি আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে দামি সম্পদ।
শেষ কথা
আমাদের লাল নীল সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখা এখনো শেষ হয়নি। ছোট ছোট ঝগড়া হয়, তর্ক হয়, আবার মিলও হয়। সময়ের সাথে সাথে আমরা বুঝে গেছি, ভালোবাসার মানে কেবল একসঙ্গে থাকা নয়; ভালোবাসার মানে প্রতিদিন একে অপরকে নতুন করে বেছে নেওয়া।
জীবনের গল্পটা এখানেই শেষ নয়। আমরা প্রতিদিন নতুন গল্প লিখি। একে অপরকে ভালোবাসি, সমর্থন দিই, আর একসঙ্গে এগিয়ে চলি।