বেশ কিছুকটা সময় নিয়েই বসে আছি কমিউনিটি সেন্টারে। বন্ধুবান্ধব সব আমাকে ঘিরে ধরেছে, আজ আমার Ex রিয়ার বিয়ে। সার্জারী কমপ্লিট করে বের হয়েই এখানে আসতে হয়েছে। দীনেশ হেসে আমায় বললো,
–মামা আজ একেবারে কবজি ডুবিয়ে খাবো। তোমার Ex বলে কথা।
সবাই হো হো করে হেসে উঠে। মেডিকেল কলেজে ক্লাসে টপ ছাত্র ছিলাম আমি। সেই জন্য অনেকটা ফেমাস ছিলাম।
মূলত আমাকে হারাতেই রিয়া আমার সাথে প্রেমের অভিনয় করেছে দীর্ঘ চার বছর। পরে একটা সময় আমি জেনে যাই সব। রিয়াও সব স্বীকার করে নেয়। সবার সামনে স্বাভাবিক থাকলেও বাড়িতে এসে অনেক কেঁদেছিলাম সেদিন।
কমিউনিটি সেন্টার থেকে বের হয়ে বাইক স্টার্ট দিবো এমন সময় আমার বন্ধু সাকিব এসে বললো, “দোস্ত তুই কি কষ্ট পাচ্ছিস? কেমন যেনো সবসময় চুপচাপ থাকিস। একটা সময় আমাদের মাতিয়ে রাখতি আর এখন ফানি মোমেন্টও হাসিস না।” মৃদু হেসে বললাম,
“তেমন কিছু না। কষ্ট পাইনি আমি। ভেতরে কোনো ফিলিংস কাজ করে না এখন আর।” সাকিব আমার কাধ চাপড়ে বললো, “ভুলে যা সব। তোর মনটা মরে গেছে সাদমান।”
বাড়িতে আমার বিয়ে নিয়ে তোড়জোড় চলছে। মা ইতিমধ্যে পাত্রীও ঠিক করে ফেলেছে। এবার আর ছাড়াছাড়ি নেই। যে করেই হোক আমায় বিয়ে করিয়েই ছাড়বেন।
আমি আর কি বলবো, বিয়ে করে নিলাম মায়ের পছন্দের পাত্রীকে। মেয়েটার নাম স্নিগ্ধা। নামের মতোই মেয়েটা একেবারে স্নিগ্ধ। তবে আমি কেনো যেনো মানিয়ে নিতে পারছিলাম না। আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট। চঞ্চল আর দুষ্টু স্বভাবের মেয়ে। সবসময় আমার সাথে দুষ্টুমি করবেই করবে। আমি বিরক্ত হলে আরো বেশি করে। বিরক্ত হতাম আমি। মা কি মনে করে যে একে আমার ঘাড়ে চাপালো। তাই সবসময় এড়িয়ে চলতাম। আমি দেখতে খারাপ নই। মোটামুটি এখন পর্যন্ত অনেক নজরকাড়া সুন্দরীদের আমার পেছনে ঘুরতে দেখেছি। কিন্তু আমিই পাত্তা দিইনি। ওইযে একবার ধোকা খেয়ে মন মরে গেছে আর জীবনে সব বসন্তও চলে গেছে।
Bengali Best Love story
সন্ধ্যার দিকে বৃষ্টি পড়ছিলো, আমি বাড়িতে ছিলাম। স্নিগ্ধা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। কালো রঙের সুতির শাড়ি ছিলো পরনে। ফর্সা গায়ে বেশ মানিয়েছে। স্নিগ্ধা আমাকে একটা কাগজের টুকরো দিলো। যাতে লিখা ছিলো, “এই যে ডাক্তারবাবু অনেক হয়েছে অবহেলা। এবার একটু ভালোবাসুন আমায়। বৃষ্টি পড়ছে বাহিরে। আমার সাথে এখন চলুন ছাদে। দুজনে বৃষ্টিতে ভিজবো। যাবেন নাকি না? না গেলে কামড়ে কামড়ে অবস্থা খারাপ করে দিবো।”
কথা না বাড়িয়ে চলে গেলাম ছাদে পাগলা মেয়ে আবার কামড়েও দেয় । বেশ খানিকক্ষণ ভিজলাম। খারাপ লাগছে না মুহুর্তটা। স্নিগ্ধার দিকে তাকাতেই মনটা ভরে গেলো। সেদিন আমি উপলব্ধি করেছি আমার জীবনে কোনোদিন বসন্ত আসেই নি। যেটাকে আমি বসন্ত ভাবতাম, যাকে আমার জীবনের বসন্তের রঙিন ফুল ভেবেছি সে ছিলো মরিচীকা৷ হারামীটাকে নিয়ে এতোই মেতে ছিলাম যে আমার অন্তরটা পুড়ে গেছে যার কারণে সৌন্দর্য আমার মনকে প্রথম দিকে ছুতে পারেনি।
বাড়িতে বন্ধুরা এসেছে নতুন ভাবিকে দেখতে। স্নিগ্ধা মায়ের কাছে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে অনেক। সে আমার বন্ধুদের সামনে যাবে না। সেদিন বেশ রেগে গেছিলাম। এমন আনকালচার্ড মেয়ে আর দেখিনি। সবাই যাওয়ার পর স্নিগ্ধা রুমে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা চিরকুট এগিয়ে দিলো। তাতে লিখা ছিলো, শুনুন ডাক্তার সাহেব, পৃথিবীর সব সম্পদ দামী। আর একজন পুরুষের সবচেয়ে দামী সম্পদ হলো তার স্ত্রী। এই দামী সম্পদ মানুষের সামনে রাখলে নজর দিবে, চুরি করে নিয়ে যাবে। তাই সাবধান। আর হুম! স্ত্রীর রাগ, অভিমান ভাঙানো স্বামীর কর্তব্য।”
সেদিন অনেক সরি বলে, কান ধরে উঠবস করে অনেক আদর, ভালোবাসা দিয়ে মহারাণীর রাগ ভাঙিয়েছি।
স্নিগ্ধা মেয়েটাকে খুব স্নিগ্ধ হাতে ভগবান আমার কাছে পাঠিয়েছেন । শুক্রবারে হসপিটালে যাবার সময় স্নিগ্ধা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তখন মনে হয় স্নিগ্ধার চোখে আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। বের হওয়ার সময় স্নিগ্ধা আমার জুতা এগিয়ে দিয়ে কলার ঠিকার করার বাহানায় একটু কাছে এসে বলে, “আমার সুদর্শন স্বামী সাবধানে যাবেন। আসার সময় আমার জন্য ফুল নিয়ে এসো।
আমার জীবনের দ্বিতীয় বসন্ত এসেছিলো সেদিন, যেদিন আমি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছি। খুশিতে আমার দুচোখে জল চলে এসেছিলো। মহারাণীর সামনে মেয়েকে কোলে নিয়ে বসতেই স্নিগ্ধা আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “ভগবান খুশি হলে বৃষ্টি দেন। আর অধিক খুশি হলে কন্যা সন্তান দান করেন। ” আমার চোখ দুটো আবারো চিকচিক করে উঠে। ভালোবাসার উষ্ণ পরশ দিয়েছি স্নিগ্ধার কপালে।
তৃতীয় বারের মতো বসন্তের আভাস পেয়েছি যখন শুনলাম স্নিগ্ধা আবারো সন্তান সম্ভাবা। খুশিতে মহারাণীকে কোলে তুলে নিয়েছিলাম। মহারাণীর পাঁচ মাস চলছে। আজ স্নিগ্ধা আমার কাধে মাথা রেখে বললো, “এই ডাক্তার সাহেব জানেন কি? আমার একটা ইচ্ছে আছে। ইচ্ছেটা হলো, গর্ভবতী নারী মারা গেলে শহীদ, আর তার সন্তান তার নারীরজ্জু ধরে টেনে স্বর্গে নিয়ে যায়।” আমি বুঝে গেছিলাম স্নিগ্ধার ইচ্ছেটা কি। তাও কিছু বলিনি তখন।
স্নিগ্ধাকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠানো হলো। আমি আজ স্নিগ্ধার অপারেশন করবো না। কারণ আমি কিছুটা ভেঙে পরেছি।একটু আগে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকার আগে স্নিগ্ধা আমার হাত ধরে হাসিমুখে বললো, “স্বর্গে আমি আপনার জন্যে অপেক্ষা করবো। এখন আমি যাচ্ছি ভগবান এর কাছে। আপনিও অপেক্ষা করুন ভগবানের ডাকের।

আঠারো বছর পেরিয়েছে আমাদের বিবাহিত জীবনের। আয়েশা আমার মেয়েটা এসে বললো, “বাবাই তাড়াতাড়ি করো দেরি হচ্ছে আমার। আজ মাদ্রাসায় পরীক্ষা আছে।” বেরিয়ে গেলাম আয়েশাকে নিয়ে। স্নিগ্ধার দুনিয়ার সফর জীবন শেষ হওয়ার আট বছর পেরিয়েছে। একদিন মা আমাকে বললো, “বাবা তুই কি আবার বিয়ে করতে চাস? তাহলে পাত্রী দেখি?” মায়ের কোলে মাথা রেখে বললাম, “মা আমিতো স্নিগ্ধাকেই স্বর্গে আমার স্ত্রী হিসেবে চাই। স্নিগ্ধার জায়গা অন্য কাউকে এতো সহজে কি করে দিয়ে দিয় বলো?
” মা আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, “আমিও চাইনা স্নিগ্ধার জায়গাটা কেউ নিক। তোকে আর আয়েশাকে নিয়েই বাকি জীবন পার করে দিবো বাবা।” মনে মনে বললাম, “সে আমার প্রিয় বসন্ত হয়েই থাক।”
মেয়েকে মাদ্রাসায় নামিয়ে দিলাম। আমার জীবনে একটা ইচ্ছে ছিলো। সেটা হলো আমার ছেলে হোক বা মেয়ে হোক তাকে আমি বড়ো ডাক্তার বানাবো। এখন সেই কাজই করছি। হয়ত এই কারণেই আমাকে এখনো দুনিয়াতে রেখেছেন।
গোধূলি সন্ধ্যা একটু পরেই সূর্য ডুববে । প্রায় আট বছর আগে এমন একটা সন্ধ্যায় স্নিগ্ধার ইচ্ছের কথাটা শুনে বললাম, “তুমি যদি আমাকে রেখে চলে যাও আমি কি করে থাকবো?” জবাবে স্নিগ্ধা আমার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, “যখন ভগবান জীবনে শ্রেষ্ঠ মুহুর্তটা আপনার কাছ থেকে নিয়ে নেবে এবং আপনি হতাশ না হয়ে সবরের মাধ্যমে আপনার রবের আনুগত্য করে যাবেন তখন ভগবানের কাছে পুরষ্কার হিসেবে আপনাকে দেয়ার জন্য সর্গ ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।”
যখনই আমার মন খারাপ হয় বা বিষন্ন হই তখনই স্নিগ্ধার বলা এই কথাটা আমার কানে বাজে। এবং এটা আমার হৃদয়ে শান্তির হাওয়া বইয়ে নিয়ে যায়।
স্নিগ্ধার মৃত্যুর পর জীবনের গতিপথ বদলে গিয়েছিল। আয়েশার হাসি আমার পৃথিবীকে রাঙিয়ে রেখেছিল। ওকে নিয়ে দিনগুলো কেটে গেল। কিন্তু ভেতরের শূন্যতা স্নিগ্ধার স্মৃতিকে আরও গভীর করে তুলেছিল।
একদিন সন্ধ্যায়:
বৃষ্টি পড়ছিল। আয়েশা পড়ার টেবিলে বসে ছিল আর আমি বারান্দায় বসে স্নিগ্ধার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ আয়েশা এসে বলল,
“বাবাই, তুমি সবসময় চুপচাপ কেন থাকো? আমি তোমায় আগের মতো হাসতে দেখতে চাই।”
আমার মেয়ে যেন আমার মনের ভেতরটা পড়ে ফেলেছিল। ওর কথায় একটা হাসি মুখে এলো। বললাম,
“তোর মায়ের মতোই তুইও আমাকে বুঝে ফেলিস আয়েশা।”
আয়েশা হেসে বলল,
“তাহলে আমাকে নিয়ে বাইরে বৃষ্টিতে ভিজতে চলো। তুমি তো বলেছিলে, মা আর তুমি একদিন ছাদে বৃষ্টিতে ভিজেছিলে। এবার আমিও তোমার সঙ্গী হব।”
আমার মেয়েটা আমাকে জীবন ফিরে দেখতে শিখিয়েছে। আয়েশার হাত ধরে বের হলাম। আমরা বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম, আর সেই মুহূর্তগুলো যেন স্নিগ্ধার স্মৃতি নতুন করে উজ্জ্বল করে দিল।
পরবর্তী দিন:
ক্লিনিকে কাজ করছিলাম। হঠাৎ একটি চিঠি পেলাম, একজন রোগীর পরিবারের তরফ থেকে। খুলে দেখি, সেটি এক মহিলার, নাম মধুরা। চিঠিতে লিখেছে,
“ডাক্তারবাবু, আপনি আমার ছেলেকে সুস্থ করে তুলেছেন। আপনার মতো মানুষ আমাদের সমাজে আশীর্বাদ। আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
চিঠি পড়ে মনে হলো, কোনো এক অজানা কারণে এই নামটি যেন কোথাও কানে লেগে গেল। পরে একদিন সেই মধুরার সঙ্গে দেখা হলো। মধুরা সদ্য বিধবা। সে তার ছেলেকে নিয়ে কঠিন সময় পার করছিল। তার মুখের শান্ত অথচ দৃঢ় অভিব্যক্তি স্নিগ্ধার কথা মনে করিয়ে দিল।
আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব:
মধুরার সঙ্গে কথা বলতে বলতে বুঝলাম, তারও জীবনের গল্পটা আমার মতোই একাকিত্বে মোড়া। তার সঙ্গে সময় কাটাতে ভালো লাগতে শুরু করল।
একদিন মধুরা বলল,
“আপনার মেয়েকে আমি বেশ পছন্দ করেছি। আয়েশা খুব বুদ্ধিমতী আর দয়ালু। তাকে দেখে মনে হয় আপনার জীবনটা সুন্দর। আপনি কি নতুন করে জীবন শুরু করতে চান?”
আমি মধুরার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললাম,
“জীবন নতুন করে শুরু করা কঠিন। তবে কেউ যদি আমার মেয়েকে ভালোবাসে, আমাকে নতুনভাবে চিনতে চায়, তাহলে হয়তো ভাবা যেতে পারে।”
আলোচনার ফলাফল:
মা বললেন,
“তুই অনেক বছর একা কাটিয়েছিস। আয়েশার জন্য হলেও একটা নতুন জীবন শুরু কর। কেউ স্নিগ্ধার জায়গা নেবে না, কিন্তু তুই আর আয়েশা একটু সঙ্গ পাবে।”
মধুরার সঙ্গে আরও কথা হলো। আমরা বুঝলাম, জীবনের শূন্যতাগুলো পূরণ করার জন্যই হয়তো ভগবান আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন।
শেষ দৃশ্য:
মধুরাকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবার আয়েশা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বাবাই, এবার আমি আবার আমার মায়ের মতো একজন পেলাম।”
আমি মধুরার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“স্নিগ্ধা আমাকে শিখিয়েছে কীভাবে ভালোবাসতে হয়। আর তুমি আমাকে শিখিয়েছ কীভাবে জীবনের শূন্যতা পূরণ করতে হয়।”
আকাশে তখনো বৃষ্টি হচ্ছিল। বসন্তের নতুন পাতায় যেন আমার জীবনের গল্প আবার লিখতে শুরু হলো।