এটা একটা পরিবারের ছেলে ও একটি মেয়ের নীরব প্রেমের গল্প। মেয়ের পরিবার ছেলেটাকে গ্রহন করতে অস্বীকৃতি জানায়। স্বাভাবিকভাবেই মেয়ের পরিবার মেয়েটাকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে ছেলেটার কোনো ভবিষৎ নেই, তার সাথে সম্পর্ক রাখাটা বোকামি ছাড়া আর কিছু না।
পরিবারের অনেক চাপে পড়ে একদিন মেয়েটা ছেলেটাকে বলে, “আমার প্রতি তোমার ভালোবাসা কতটা গভীর? তুমি একটা কিছু অন্তত করো না হলে আমাদের সম্পর্ক কেউ মেনে নেবে না।” ছেলেটা কোন উত্তর খুঁজে পায় না। সে চুপ করে থাকে। মেয়েটা রাগ হয়ে চলে যায়। তারপরেও স্বপ্নবিলাসী ছেলেটা তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে, কিছুটা অন্জন’দা এর গানের মতো, “সাদা-কালো এই জন্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে, তোমার-আমার লাল-নীল সংসার।
ছেলেটা একদিন পড়াশুনার জন্য বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। যাওয়ার আগ-মুহূর্তে সে মেয়েটাকে বলে, “আমি হয়তো কথায় খুব একটা পারদর্শী না, কিন্তু আমি জানি যে আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তারপরেও তুমি যদি চাও, তোমার-আমার বিয়ের কথা আমি তোমার পরিবারকে একবার বলে দেখতে পারি। তুমি কি আমার সাথে সারাজীবন কাটাতে রাজি আছ?”
মেয়েটা ছেলের দৃঢ়-সংকল্প দেখে রাজি হয়। ছেলেটা মেয়ের পরিবারকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করে ফেলে। তারপর তাদের এনগেজমেন্ট হয়ে যায় এবং সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে দেশে ফিরলে তারপর তাদের বিয়ে হবে। এরপর ছেলেটা চলে যায় দেশের বাইরে।
মেয়েটা একটা অফিসে কাজ করা শুরু করে দেয়। এদিকে ছেলেটাও তার রিসার্চ-ওয়ার্ক নিয়ে দেশের বাইরে ব্যস্ত। তারপরেও তারা শত ব্যস্ততার মাঝেও ফোন আর ই-মেইলের মাধ্যমে তাদের ভালোবাসার অনুভূতি যতটা সম্ভব আদান-প্রদান করে।
একদিন মেয়েটা অফিসে যাওয়ার পথে রোড-অ্যাক্সিডেন্ট করে। সেন্স ফিরে সে দেখতে পায় যে সে হাসপাতালে ভর্তি এবং বুঝতে পারে যে সে মারাত্মকভাবে আহত। তার বাবা-মাকে বিছানার পাশে দেখতে পায় সে। তার মা কান্না করতেছে তা বুঝতে পেরে যখন মেয়েটা কথা বলতে যায় তখন সে বুঝতে পারে যে তার বাকশক্তি লোপ পেয়েছে। ডাক্তারের ভাষ্যমতে মেয়েটা তার ব্রেনে আঘাত পাওয়ায় আজীবনের মতো বোবা হয়ে গেছে।
একসময় মেয়েটা খানিকটা সুস্থ হয়ে বাসায় চলে আসে। এদিকে ছেলেটা তাকে বার বার ফোন করতে থাকে কিন্তু মেয়েটা বোবা বলে তার করার কিছুই থাকে না। মেয়েটা একদিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। সে তার কথোপোকথন-হীন এই জীবনের সাথে ছেলেটাকে আর জড়াতে চায় না।
তার ফলশ্রুতিতে সে একদিন একটা মিথ্যা চিঠিতে লেখে যে সে আর ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না। ছেলেটা মেয়েটাকে হাজার-হাজার ই-মেইল করে কিন্তু তার কোন রিপ্লাই সে পায় না। ছেলেটা শত-শত বার ফোন করে কিন্তু মেয়েটার ফোন রিসিভ না করে নীরবে কান্না করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
একদিন মেয়েটার পরিবার বাসা বদল করে অন্য কোন এলাকায় নতুন কোন একটা পরিবেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে করে মেয়েটা কিছুটা হলেও এই দুঃস্মৃতী ভূলে যায় এবং সুখে থাকে।
নতুন পরিবেশে মেয়েটা “সাইন-ল্যাংগুয়েজ” শেখে এবং নতুন জীবন শুরু করে। বছর দুয়েক পর একদিন মেয়েটার এক বান্ধবী এখানে চলে আসে এবং মেয়েটাকে বলে যে ছেলেটা দেশে এসেছে । মেয়েটা তার বান্ধবীকে রিকুয়েস্ট করে যাতে ছেলেটা কোনভাবেই যেন তার এই অবস্থার কথা জানতে না পারে। তারপর কয়েকদিন পর মেয়েটার বান্ধবী চলে যায়।

আরো এক বছর পর আবার একদিন মেয়েটার বান্ধবী মেয়েটার কাছে একটা ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে চলে আসে। মেয়েটা কার্ড খুলে দেখতে পায় যে এটা ছেলেটার বিয়ের ইনভাইটেশন কার্ড। মেয়েটা অবাক হয়ে যায় যখন পাত্রীর জায়গায় তার নিজের নাম দেখতে পায়। মেয়েটা যখন তার বান্ধবীর কাছে এ সম্পর্কে কিছু জানতে চাইবে তখন সে দেখতে পায় যে ছেলেটা তার সামনে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা তখন “সাইন ল্যাংগুয়েজ” ব্যবহার করে মেয়েটাকে বলে, “I’ve spent a year’s time to learn sign language. Just to let you know that I’ve not forgotten our promise. Let me have the chance to be your voice. I Love You.” এই বলে ছেলেটা আবার সেই এনগেজমেন্ট রিং মেয়েটাকে পড়িয়ে দেয়। কয়েক বছর পর মেয়েটা আবার হেসে উঠে। এ যেন এক নীরব ভালোবাসার নীরব হাসি।
মেয়েটার চোখে পানি চলে আসে। এতদিন ধরে সে যা সহ্য করেছে, সব অনুভূতি যেন এক মুহূর্তে ভেঙে পড়লো। ছেলেটার কথা শুনে মেয়েটা নিজের কষ্ট আর ধরে রাখতে পারলো না। তার চোখ দিয়ে অশ্রুধারা বইতে শুরু করলো।
ছেলেটা এগিয়ে এসে মেয়েটার হাত ধরে সাইন ল্যাংগুয়েজে বললো,
“তুমি জানো, এই এক বছর আমি শুধু একটাই জিনিস শিখেছি। কীভাবে তোমার সাথে কথা বলতে হয়। তুমি যদি আমার পাশে থেকেও নীরব থাকো, তবুও আমি কথা বলবো। তুমি যদি আমাকে না বলো, আমি তোমার মন বুঝবো। আমি তোমাকে কখনো একা থাকতে দেবো না।”
মেয়েটার কান্না যেন থামার নামই নিচ্ছে না। তার মনের সমস্ত কষ্ট, যন্ত্রণা, এবং ভালোবাসা একসাথে প্রকাশিত হচ্ছে। সে ছেলেটার হাত শক্ত করে ধরে সাইন ল্যাংগুয়েজে বললো,
“কেন? কেন তুমি এতটা করছো আমার জন্য? আমার জীবন তো ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি তো আর আগের মতো তোমার পাশে দাঁড়াতে পারবো না।”
ছেলেটা মেয়েটার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাইন ল্যাংগুয়েজে উত্তর দিলো,
“তোমার পাশে দাঁড়ানোর জন্য তোমার কথা বলার প্রয়োজন নেই। তোমার শুধু আমার পাশে থাকা প্রয়োজন। আমি তোমার জন্য আছি, তোমার কষ্ট আমার কষ্ট। তুমি যতদিন আমার পাশে থাকবে, ততদিন আমার জীবন পূর্ণ।”
মেয়েটার মা-বাবা দূর থেকে এই দৃশ্য দেখছিলেন। তারা এতদিন ছেলেটাকে ভুল বোঝার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আজ তার ভালোবাসার গভীরতা দেখে তারা আর কোন বাধা দেওয়ার সাহস পেলেন না। মেয়েটার মা এগিয়ে এসে ছেলেটার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“তুমি সত্যিই প্রমাণ করেছো যে ভালোবাসা শুধু কথার নয়, কাজের। আমাদের মেয়ে তোমার সঙ্গে সুখী হবে। আমরা আর তোমাদের ভালোবাসার পথে বাধা হবো না।”
এই কথাগুলো শোনার পর ছেলেটা মেয়েটার হাতে আবার সেই এনগেজমেন্ট রিংটা পরিয়ে দিলো। চারদিকে যেন এক অদ্ভুত নীরব শান্তি। মেয়েটা সাইন ল্যাংগুয়েজে বললো,
“তুমি যদি আমার জীবনের প্রতিটি অন্ধকার দিনকে আলোকিত করতে পারো, তবে আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চাই।”
এই মুহূর্তে, তাদের চোখে শুধু ভালোবাসা। এই ভালোবাসা শব্দহীন, তবুও একে বোঝার জন্য কোন শব্দের প্রয়োজন নেই। এই ভালোবাসা তাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে অর্থবহ করে তুলেছে।
বিয়ের পর ছেলেটা আর মেয়েটা একসঙ্গে তাদের জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করলো। ছেলেটা মেয়েটার পাশে থেকে তাকে প্রতিদিন অনুপ্রাণিত করতে লাগলো। মেয়েটা তার নতুন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ছেলেটার সাহচর্যে শক্তি খুঁজে পেত।
তারা একসঙ্গে সাইন ল্যাংগুয়েজে কথা বলতো, হাসতো, গান গাইতো। তাদের নীরব ভালোবাসার গল্প সবাইকে নতুন করে জীবন এবং ভালোবাসার মানে শিখিয়ে দিত।
সমাপ্ত।