সাথী অভিমানে বলল,
“আমার কথার দাম নাই! তাই না? আমি মরলেই কি, বাঁচলেই কি, বা বাপের বাড়ি চলে গেলেই কি! তাতে তো আপনার কিছু আসে যায় না।”
তাওহীদ রাগ সামলাতে না পেরে বলল,
“হ্যাঁ ঠিক! আপনার কথার কোনো দাম নাই। আপনি আমার কে? মরলেই কি, বাঁচলেই কি, বা বাপের বাড়ি চলে গেলেই কি! বরং আমার ভালো হবে—আরেকটা বউ এনে প্রেম-ভালবাসা করব।”
এই কথায় সাথীর চোখে পানি চলে আসে। মনে মনে বলে, “আমি কি এমন ভুল করলাম যে উনি এমন কথা বললেন!” ভয় আর অভিমানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
কিছুক্ষণ পর সাথী অভিমানের সুরে বলে,
“ছি! এই ছিল আপনার মনের কথা! আল্লাহ, আমি মরলেই ভালো হত। আপনি তো বুঝতে পারেন না, আমি অভিমানে বলেছি। আমার এমন জীবন রাখার মানে কি!”
তাওহীদ তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
“তোমার এমন অভিমানী কথাগুলো শুনলে আমার খুব কষ্ট হয়। বারবার বলি, এসব কথা যেন না বলো। তারপরও কেন বলো?”
সাথী এবার ভেজা চোখে বলে,
“আপনি তো আমাকে বুঝবেন না। আমি তো আপনার জন্য সব ছেড়ে এসেছি। আপনি বললে হাসি, আপনি বললে কাঁদি। আর আপনি আমার অভিমানটুকু বুঝতেও চান না।”
তাওহীদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“তুমি জানো না, আমি রেগে গিয়ে কী কী বলে ফেলি। তুমি আমার জীবনের সবকিছু, সাথী। তোমার কিছু হলে আমি কোথায় থাকব?”
সাথী মুচকি হেসে বলে,
“তাহলে আমাকে একটু ভালোবাসা দিয়ে দেখান।”
তাওহীদ সাথীর হাত ধরে বলে,
“তোমার অভিমান, তোমার কান্না—সবকিছু আমার জীবনের অংশ। কিন্তু তোমার মুখে মৃত্যু বা ছেড়ে যাওয়ার কথা শুনলে আমার হৃদয় ভেঙে যায়। আর কখনো এমন কথা বলবে না। কথা দাও।”
সাথী মাথা নিচু করে বলে,
“কথা দিচ্ছি। আর কখনো এমন কথা বলব না। আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন।”
তাওহীদ হেসে বলে,
“তোমার এই অভিমানগুলোই তো আমাকে তোমার প্রেমে পাগল করে রাখে। তোমার ঠান্ডা লেগেছে, তাই তোমাকে আইসক্রিম খেতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু মনে থাকে, তুমি যাই চাও, তা আমি কখনোই ফেলতে পারি না।”
তারপর তাওহীদ নিজেই আইসক্রিম এনে সাথীর সামনে বসে।
“এবার একটু খাও। কিন্তু পরে যদি বেশি ঠান্ডা লাগে, আমিই কিন্তু ওষুধ খাওয়াব।”
সাথী হাসি মুখে আইসক্রিম খেতে শুরু করে। আর বলে,
“তুমি যদি সবসময় এমন করে আমার সব কথা মানো, তাহলে আমি তো তোমার কথায় সারা জীবন রাগ করতে পারব না।”
তাওহীদ মুচকি হেসে বলে,
“তোমার রাগ, অভিমান, কান্না—সবকিছু নিয়েই তো আমার পৃথিবী। তুমি থাকলে, আমি আছি।”
সেই রাতে তারা একে অপরের কাছাকাছি বসে, পুরনো রাগ-অভিমান ভুলে ভালোবাসায় মিশে যায়। ভালোবাসার গভীরতা যেন আরও বেড়ে যায়।
এভাবেই তাদের জীবনে রাগ, অভিমান আর মিষ্টি কথার মধ্য দিয়ে ভালবাসার পথ চলা চলতে থাকে।
সাথী আর তাওহীদের সংসার সুখে-দুঃখে কাটছে। মাঝে মাঝে রাগ-অভিমানের ঝড় উঠলেও তাদের ভালোবাসার বন্ধন এতটাই গভীর যে তারা তা সহজেই পেরিয়ে যায়।
একদিন সন্ধ্যায়, তাওহীদ অফিস থেকে বাড়ি ফিরল। দরজা খুলেই দেখল সাথী রান্নাঘরে ব্যস্ত। তাওহীদের প্রিয় খাবারের গন্ধ ভেসে আসছে। তাওহীদ হাসিমুখে বলল,
“আজ কিছু স্পেশাল আছে নাকি?”
সাথী পিছন ফিরে মুচকি হেসে বলল,
“তুমি তো বলেছিলে আমার রান্না তোমার খুব পছন্দ। তাই ভাবলাম, আজ তোমার প্রিয় কিছু বানাই।”
তাওহীদ সাথীর কাছে গিয়ে বলল,
“তুমি শুধু রান্না নয়, আমার জীবনের সবকিছু। আমার দিন শুরু হয় তোমার মুখ দেখে, আর শেষ হয় তোমার হাসি দিয়ে।”
সাথী লজ্জায় বলল,
“এত মিষ্টি কথা বলো কেন? আমি তো ভুলেই যাই তুমি রাগী মানুষ।”
তাওহীদ মৃদু হেসে বলল,
“তোমার জন্যই তো আমি বদলে গেছি।”
রাতের খাবার শেষে সাথী বারান্দায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তাওহীদ কাছে এসে পাশে বসল। সাথী হঠাৎ বলে উঠল,
“তুমি জানো, আমি মাঝে মাঝে ভয় পাই।”
তাওহীদ অবাক হয়ে বলল,
“ভয়? কিসের ভয়, সাথী?”
সাথী শান্ত গলায় বলল,
“তোমাকে হারানোর ভয়। কখনো যদি আমার ভুলে তুমি সত্যি রেগে যাও বা আমাকে ছেড়ে চলে যাও…”
তাওহীদ সাথীর হাত ধরে বলল,
“এই ভয়গুলো আর কখনো মনে আনবে না। তুমি জানো না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমার অভিমান, কান্না—সবকিছু আমার জীবনের রং। আমি যদি কখনো রাগ করি, সেটা আমার মনের দুর্বলতা। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।”
সাথী চোখের জল সামলে বলল,
“তুমি জানো, তাওহীদ, আমি মনে মনে সবসময় চাই যেন আমাদের এমন ভালোবাসা সারাজীবন থাকে।”
তাওহীদ সাথীকে তার বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“তোমার এই চাওয়া আমারও চাওয়া। আমরা একে অপরের জন্যই তো বেঁচে আছি। তোমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার কাছে অমূল্য।”
এরপর কয়েকদিন পরের ঘটনা। সাথীর জন্মদিন ছিল। তাওহীদ চুপচাপ একটা চমক দেওয়ার পরিকল্পনা করল। সাথী ভেবেছিল তাওহীদ হয়তো জন্মদিন ভুলে গেছে। সারা দিন তাওহীদের কাছ থেকে কোনো শুভেচ্ছা বা উপহার পায়নি। অভিমানে চুপচাপ বসে ছিল।
রাতের দিকে তাওহীদ সাথীকে ডেকে বলল,
“চলো, একটা জায়গায় নিয়ে যাই।”
সাথী কিছু না বুঝেই তাওহীদের সঙ্গে বাইরে বের হলো। তাওহীদ তাকে শহরের একটি সুন্দর রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেল, যেখানে পুরো জায়গাটা মোমবাতি আর ফুল দিয়ে সাজানো ছিল।
সাথী অবাক হয়ে বলল,
“এতকিছু কেন করেছ?”
তাওহীদ হেসে বলল,
“তোমার জন্য। কারণ তুমি আমার জীবনের আলো। তোমার জন্মদিন আমার কাছে বিশেষ দিন।”
তাওহীদ সাথীর জন্য প্রিয় গান চালিয়ে তার সামনে কেক আনল। কেকের ওপরে লেখা ছিল,
“আমার অভিমানী রানি, শুভ জন্মদিন।”
সাথীর চোখে জল চলে এলো। সে বলল,
“তুমি এমন কেন! সবসময় আমাকে এভাবে ভালোবেসে চমকে দাও। আমি তো এমন কিছু আশা করিনি।”
তাওহীদ মৃদু হেসে বলল,
“তুমি আমার সব আশা-ভরসার উৎস। তোমার হাসি দেখলেই আমার সব সুখ মেলে। তোমার জন্মদিনে আমি তোমাকে হাসি উপহার দিতে চেয়েছিলাম।”
সেই রাতে সাথী আর তাওহীদের মধ্যে যেন নতুন করে ভালোবাসার বন্ধন তৈরি হলো।
তাদের জীবনের গল্প এভাবেই রাগ, অভিমান আর ভালোবাসার মিষ্টি ছোঁয়ায় ভরপুর। জীবন চলার পথে হয়তো আরও ঝড় আসবে, কিন্তু তারা জানে একে অপরের হাত ধরে সবকিছু সামলে নিতে পারবে।