আমার নাম মৌ ,দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের দুটো বছর পেরিয়ে গেলো আজ আমাদের দ্বিতীয় বিবাহবার্ষিকী।
আমার আজও মনে সেই দুবছর আগের কথা , বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করে দিয়েছিলো কিন্তু সেদিন বিয়ের মণ্ডপ থেকেই নয়নের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলাম। বাবা কে এমনিতেই অনেক ভয় করতাম তাও সব ভয় দূরে রেখে আমার ভালোবাসার কথা বাবা কে জানিও ছিলাম তার পর বাবা একদিন নয়ন কে আমাদের বাড়ি নিয়ে আসতে বলে।
কথা মতো নয়নও কে নিয়ে এসে ছিলাম। আমি নয়ন বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম
বাবা:- কি নাম তোমার।
নয়ন:- নয়ন
বাবা:- বাড়িতে কে কে আছে ??
নয়ন:- জি আমারবাড়িতে কেও নেয় অনেক কম বয়সে বাবা মা মারা যায়, আর কাকু কাকিমাও আমাকে তাদের সাথে রাখেনি তাই , ছোটর থেকেই অনাথ আশ্রমে বড়ো হয়েছি , আর এখন মৌ এর সাথে একই কলেজে তৃতীয় সেমিস্টারে পড়ছি , টিউশন পড়িয়ে নিজের খরচা চালায়।
বাবা:- তোর নিজের ঠিক নেই আবার বিয়ে তাও আবার আমার মেয়েকে ,তোর সাহস তো কম নয় ,দেখছি। এক্ষুনি বের হয়ে যা আমার বাড়ি থেকে , আর শুনে রাখ আমার মেয়ের আসে পাশে যেন না দেখি তোকে।
সেদিন নয়ন চলে যাবার পর বাবা আমাকে জীবনে প্রথম বার চড় মেরেছিলো। বাবার একটাই কথা ছিল যে ছেলের নিজে কি খাবে তার ঠিক নেই তুই তার তার সাথে কিভাবে থাকবি।
বাবার এই সব কথা তখন একদম মাথায় ঢুকছে না শুধু মনে হচ্ছে আমি নয়ন কে ছাড়া বাঁচবো না আর নয়নও আমাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। তারপর আমরা প্লেন করি বিয়ের দিন পালিয়ে যাবো সেই মতো আমিও বাড়ির থেকে বেরিয়ে যায় আর নয়ন তার বন্ধুর সাথে এসে আমাকে নিয়ে যায়।
তার পরের দিন গুলো সোজা ছিল না অনেক কষ্টে দুজনেই পড়াশুনা শেষ করেছি , তার পর দুজনে টিউশন পড়িয়েও কোনো সময় না খেয়ে ঘুমিয়েছি। কিন্তু আমাদের ছোটো সংসারে ভালোবাসার অভাব ছিল না , আর নয়নেরও আমাকে ছাড়া আর কেও ছিল না। তারপর নয়নের চাকরি হয় সংসারে এই একটু একটু করে সুখ আসছিলো কিন্তু কোথায় আছে না সুখ সবার সহ্য হয় না সেইরকম আমাদেরও হলো।
নয়ন কেমন যেন এখন পাল্টে গেছে আমার দিকে ভালো করে তাকায় না , অফিস থেকেও দেরি করে আসে ,আর আগের মতো কল করে জিজ্ঞাসাও করে না আমার জানপাখি টা খাবার খেয়েছে কি না ?
কিন্তু আজ ওকে এমন একটি খুশির খবর দেব যে ও লাফাবে ,হ্যাঁ আমাদের পরিবারে একজন ছোট্ট সদস্য আস্তে চলেছে। ওই যে ও এসেছে ?
Bengali Love Story
মৌ:- হ্যাপি মেরেজ ডে।
নয়ন:- আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী ছিল ??
মৌ:- তোমার মনে নেয় ?? আচ্ছা কোনো বেপার নেই , চলো অনেক রান্না করেছি একসাথে খাবো।
নয়ন:- আমি খেয়ে এসেছি।
মৌ:- মজা করছো ?
নয়ন:- না। তোমার সাথে জরুরি কথা আছে মৌ।
মৌ:- আমারো।
নয়ন:- আচ্ছা বলো ?
মৌ:- না তুমি আগে
নয়ন:- দেখো মৌ আমি জানি তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে তাই যা বলছি ভেবে দেখো
মৌ:- কি এমন কথা বলবে ??
নয়ন:- আমি ডিভোর্স চাই।
মৌ:- মানে কি ??
নয়ন:- সোজা ভাবে বলি। আমার মনে হয় আমরা দুজন দুজন এর জন্য নয়। সম্পর্ক টা কেমন যেন একঘেয়ে হয়ে গেছে।
মৌ:- এটাই কারণ ??
নয়ন:- না মানে আমার অফিস এর স্টাফ রিয়া কে আমি খুব ভালোবাসি , রিয়া আর আমি বিয়ে করতে চাই।
মৌ:- আচ্ছা পেপার্স রেডি করো।
নয়ন:- না মানে এই যে পেপার্স।
মৌ:- ওকে দাও সই করে দিচ্ছি।
নয়ন:- থাঙ্কস। বলছি কি যেন বলছিলে তুমি ??
মৌ:- না কিছু না থাক , সুখে থেকো
সেদিন আমার কাছে বলার অনেক কিছু থাকলেও আমি কিছু বলি নি কারণ জোর করে আটকে রাখায় আমি বিশ্বাসী নয়।
পরের দিনই বেরিয়ে এসেছিলাম নয়ন এর জীবন থেকে , তারপর কিছু দিন আমার ফ্রেন্ড এর বাড়িতে ছিলাম। কারন বাড়ি যাওয়ার অধিকার টুকুও আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি এতো অসহায় ছিলাম যে আমার সন্তান তার বাবার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে আমার কাছে কোনো উত্তর থাকবে না।
Bengali sad love story
কিছু দিন পর অনেক চেষ্টার ফলে আমিও ভালো রকমের চাকরি পেয়ে যায় , পোস্টিং ধুরে হওয়ায় আমিও চলে যায়। আর ওখানেই একলা নতুন জীবন শুরু করি।
৫ বছর পর আজ আমি পা রেখেছি সেই চেনা শহরে। যেখানে আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা সংসার ছিল যদিও সেটা এখন রিয়ার সংসার ছিল।
উহু আমি ফিরতে চায়নি এই শহরে কিন্তু টার্ন্সপার এখানে হয়েছে তাই কিছু করার নেই।
একদিন বিকেলে আমার মেয়ে কে নিয়ে পার্কে ছিলাম। আমরা মা মেয়ে বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম।
হটাৎ দেখলাম দূর থেকে কেও আসছে মুখ টা চেনা চেনা লাগছে ও এতো নয়ন।

নয়ন:- কেমন আছো ?
মৌ:- ভালো। তুমি?
নয়ন:- আমি ভালো নেই ,তোমাকে সেদিন ছেড়ে যা ভুল করেছি তার মাসুল আমি আজও গুনছি। বিয়ের এক বছরের মধ্য রিয়া তার বয়ফ্রেন্ড এর সাথে পালিয়েছে সে আমার টাকা পয়সা নেয়ার জন্য নাটক করেছিল। আচ্ছা এই পিচ্চি মেয়ে টা কে
মৌ:-আমার মেয়ে
.নয়ন:- যাক শুনে ভালো লাগলো তুমিও সংসারী হয়েছো। তা ওর বাবা কোথায় ?
মৌ:- মারা গেছে।
নয়ন:- আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে , ফিরে আসবে আমার জীবনে ??
মৌ:- যা আমি একবার ফেলে আসি তা আর তাকায় না , আর ভালো থেকো আসছি
নয়নের সাথে পার্কের সেই সংক্ষিপ্ত কথোপকথনের পর মৌ ফিরে এলেন তার মেয়েকে নিয়ে। ছোট্ট মেয়েটা নিজের মায়ের হাত ধরে হাঁটছিল, কিন্তু মৌর মনে তখন অজস্র চিন্তার ঢেউ। নয়নের অনুশোচনা দেখে এক মুহূর্তের জন্য তার মনের কোণে একটি পুরনো অনুভূতি জাগ্রত হয়েছিল, তবে তা অনেক আগেই বাস্তবতার আঘাতে নিভে গিয়েছিল।
Bengali dukher golpo
রাতে বাড়ি ফিরে মৌ মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে নিজের চেয়ারে বসে ভাবছিলেন। তিনি একলা জীবনে অনেক কিছু শিখেছেন। নয়নের প্রতারণা, তার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, এবং একা মেয়েকে বড় করার সংগ্রাম—সবকিছুই তাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছিল। আজ তিনি আর সেই পুরনো মৌ নন, যিনি নয়নের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। আজ তিনি একজন মা, একজন স্বাধীন নারী, যিনি নিজের এবং মেয়ের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করতে চান।
পরের দিন অফিসে কাজ করছিলেন মৌ। হঠাৎ তার ডেস্কে একটি চিঠি এলো। খামের মধ্যে একটি ছোট চিঠি এবং একটি পেনড্রাইভ। চিঠিতে লেখা:
**”মৌ,
আমার কিছু কথা তোমার কাছে পৌঁছানো খুব জরুরি। দয়া করে এটি শুনবে।
নয়ন”**
মৌ কিছুক্ষণ চিঠিটা হাতে ধরে বসে রইলেন। পড়বেন কি পড়বেন না, বুঝতে পারছিলেন না। অনেক দ্বিধার পর পেনড্রাইভটি ল্যাপটপে লাগালেন। সেখানে একটি ভিডিও চালু হলো। নয়নের ক্লান্ত মুখটি স্ক্রিনে ফুটে উঠলো।
নয়ন:
“মৌ,
আমি জানি তোমার কাছে আমার কোনো অধিকার নেই, কিন্তু আমি এটুকু জানাতে চাই যে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিন কমেনি। সেদিন রিয়ার প্রতি মোহ আমাকে অন্ধ করে দিয়েছিল। আমি তোমাকে হারিয়ে জীবনের মানেটাই ভুলে গিয়েছিলাম। আমি আজও তোমার জন্য অপেক্ষা করি, মৌ। যদি পারো, আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও।”
মৌ ভিডিওটি শেষ করলেন। নয়নের অনুশোচনা তার হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও, তার মনের দৃঢ়তা অটুট রইল। তিনি জানতেন, জীবন তাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ভালোবাসা মানে কেবল একে অপরের পাশে থাকা নয়, বরং সম্মান ও আস্থা বজায় রাখা।
কয়েকদিন পরে পার্কে আবার নয়নের সাথে দেখা হয়। এবার নয়নের চোখে আকুতি স্পষ্ট। তিনি মৌর সামনে এসে দাঁড়ালেন।
নয়ন:
“মৌ, প্লিজ আমাকে আরেকটা সুযোগ দাও। আমি জানি, তোমার জন্য যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য, কিন্তু আমি তোমাকে হারাতে চাই না।”
মৌ:
“নয়ন, মানুষ অতীত ভুলতে পারে, কিন্তু ক্ষতগুলো থেকে যায়। তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই, তবে আমি অতীতের ছায়ায় বাঁচতে পারবো না। আমি যা কিছু হারিয়েছি, তা আমি নিজেকে শক্তিশালী করে ফিরে পেয়েছি। এখন আমার জীবনে নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। সেখানে তোমার জায়গা নেই।”
মৌর কথা শুনে নয়ন থমকে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, জীবনের কোনো ভুল শুধরানোর সুযোগ সবসময় থাকে না। মৌ মেয়ের হাত ধরে হেঁটে গেলেন, আর নয়ন দাঁড়িয়ে রইলেন।
মৌ তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। তার জীবনে একটাই লক্ষ্য—তার মেয়েকে একটি ভালো জীবন দেওয়া। তিনি জানতেন, সুখ পাওয়ার জন্য কারও সাহায্য বা সঙ্গী প্রয়োজন নেই। নিজের আত্মবিশ্বাসই যথেষ্ট।
শেষ।