ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ক্যাম্পাসে হাঁটছিলাম একা একা। মাথায় হাজারো ভাবনা, অথচ চারপাশের গাছের ছায়াগুলোও যেন আমাকে একা করে দিচ্ছে। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ছেলে লাফ দিয়ে সামনে এসে পড়লো। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ছেলেটা এক অদ্ভুত কাচুমাচু মুখ করে বললো,
“আপনি অর্পিতা, আর্কিটেকচার ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট, দ্বিতীয় বর্ষ।”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমার চোখে গভীর একটা ভাব এনে ছোট করে বললাম, “হুম, তো?”
ছেলেটা কিছুটা আমতা আমতা করে বললো,
“আমি আরিফ, মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, প্রথম বর্ষ।”
“তাহলে? কী বলতে চাও? তাড়াতাড়ি বল। আমার হাতে সময় নেই। বাসায় যাবো।”
জুনিয়র হওয়ার কারণে আমি সরাসরি তুই করেই বললাম। ছেলেটা হঠাৎ বলে বসলো,
“চলুন না ক্যান্টিনে বসে কফি খেতে খেতে বলি।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “এখানেই বল, আমার হাতে এত সময় নেই।”
“প্লিজ, জাস্ট দশ মিনিট! এর বেশি এক মিনিটও না।”
ছেলেটার অসহায় দৃষ্টি আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন আমি ‘না’ বললে সে কান্না শুরু করবে। তার চেহারায় এক অদ্ভুত ইনোসেন্স ছিল, যা আমাকে মায়ায় বাঁধতে শুরু করেছিল। অনুরোধটা ফেলতে পারলাম না। বললাম, “ঠিক আছে, দশ মিনিট। তবে এক মিনিটও বেশি না।”
ছেলেটা যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লটারি জিতেছে এমন খুশি হয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। কফির অর্ডার দিয়ে কফিতে চুমুক দিতে দিতে বললাম,
“এবার বল, কী বলবে?”
“আসলে আমি আপনাকে অনেক দিন ধরেই ফলো করছি। আমি জানি, আপনার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “তুই এই সব ফালতু কথা জিজ্ঞেস করার জন্য ডাকলি?”
ছেলেটা তাড়াতাড়ি বললো, “না না, আসল কথাটা এখনো বলিনি।”
“তাহলে বল।”
“আমার বহু দিনের স্বপ্ন—আমি আমার থেকে সিনিয়র একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবো। আপনি কি আমার ইচ্ছাটা পূরণ করবেন?”
ছেলেটার কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। হো হো করে হেসে উঠলাম। এরকম অদ্ভুত স্বপ্নও যে মানুষের থাকতে পারে তা জানা ছিল না। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বললাম,
“মানুষের অনেক ধরণের স্বপ্ন শুনেছি, কিন্তু এটা তো সত্যিই অদ্ভুত। আর আমি কেন তোর প্রস্তাবে রাজি হবো?”
“কারণ আমি সত্যি সত্যি প্রেম করতে বলছি না। শুধু পাঁচ দিন প্রেমের অভিনয় করবেন।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “এটা তো কখনো সম্ভব না।”
“প্লিজ, মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। অনেক খুঁজে আপনাকে পেয়েছি। একমাত্র আপনিই আছেন যার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”
ছেলেটার কথাগুলো শুনে আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ছোটবেলা থেকে বাবা-মার কথাই শুনে চলেছি। তারা আমার জীবনের সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছেন, এমনকি পেন্সিলের রং পর্যন্ত তারা ঠিক করে দিতেন। জীবনে কোনো স্বাধীনতা পাইনি। একঘেয়ে এই জীবন থেকে বেরোনোর একটা উপায় হয়তো এই পাঁচ দিনের জন্য অভিনয়ই। আমি ভেবে দেখলাম, এই ছেলেটা হয়তো ঠিকই বলছে।
“ঠিক আছে,” বললাম। “পাঁচ দিনের বেশি কিন্তু এক মিনিটও না।”
ছেলেটার চোখে এক অন্যরকম আনন্দ। সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমার হাতে একটা চুমু খেয়ে বললো, “আপনার এই পাঁচ দিনকে আমি জীবনের সেরা দিন বানিয়ে দেবো।”
এরপর আমরা একসাথে পাঁচটা দিন কাটানোর জন্য শুরুর প্রস্তুতি নিলাম। প্রথম দিন আমরা ক্যান্টিনে কফি খেতে খেতে গল্প করলাম। দ্বিতীয় দিনে সিনেমা দেখতে গেলাম। তৃতীয় দিনে শহরের পাশের একটা নদীর ধারে বেড়াতে গিয়েছিলাম। প্রতিটা মুহূর্ত যেন এক স্বপ্ন। আমি ভুলে গিয়েছিলাম এটা প্রেমের অভিনয়।
চতুর্থ দিনে আরিফ আমাকে নিয়ে গেল শহরের বাইরে একটা গ্রামে। সেখানকার মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এক শিউলি গাছের নিচে। সেখানে একটা দোলনা ঝুলছিল, যেটা ও সাজিয়েছে আমার জন্য। আমি দোলনায় বসে যখন দুলছিলাম, মনে হচ্ছিল জীবন এত সুন্দর হতে পারে! আরিফ নিচে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। হঠাৎ সে ফুল হাতে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বললো,
“তুমি আমার জীবনের স্বপ্নের পরী। তুমি কি আমাকে তোমার পৃথিবীতে স্থান দেবে?”
আমি তার হাত থেকে ফুলটা নিলাম। মনে হচ্ছিল, আমি এক অন্য জগতে আছি।
পঞ্চম দিনে সে আমাকে পদ্মা নদীর পাড়ে নিয়ে গেল। নৌকায় বসে চাঁদের আলো আর মোমবাতির আলোয় একসাথে ভাজা ইলিশ মাছ খেলাম। তার ছোট ছোট কাজগুলো আমার মনে গেঁথে গেল। এই দিনগুলো যেন আমার জীবনের সব রঙ মিশিয়ে দিয়েছে।
শেষ দিন ও আমাকে ক্যাম্পাসে নিয়ে গেল। ওর বিদায় জানানোর সময় মনে হচ্ছিল, আমি যেন নিজের একটা অংশ হারাচ্ছি। আরিফ বললো,
“তোমার এই পাঁচটা দিন আমার জীবনের সেরা সময়। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, অর্পিতা।”
কথাগুলো শুনে আমার চোখে জল চলে এলো। আরিফ চলে গেল, কিন্তু ওর স্মৃতি থেকে গেল আমার মনের গভীরে।
এরপর এক সপ্তাহ কেটে গেল। আমি ক্লাসে বসে, ক্যাম্পাসে হাঁটতে, সব সময় আরিফকে খুঁজতাম। একদিন ওর মতো কাউকে দেখে ছুটে গিয়ে দেখি সত্যিই আরিফ। সে হাসছিল। তার হাত ধরে আমি বললাম,
“তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছো। তোমাকে আর কখনো হারাতে দেব না।”
আরিফ আমার হাত শক্ত করে ধরে বললো,
“তোমার ভালোবাসার কাছে আমি বারবার ফিরে আসবো।”
তখনই বুঝেছিলাম, এই অভিনয় আসলে আমাদের জীবনের সবচেয়ে সত্যি ভালোবাসার গল্প।
পাঁচটা দিন যেন স্বপ্নের মতো কেটেছিল। কিন্তু এরপরই বাস্তবতার দরজা ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করলো। আমি আরিফকে সবসময় মনের মধ্যে অনুভব করলেও, ওর সঙ্গে আর দেখা হয়নি। এমনকি ওর ফোন নম্বরও আমার কাছে ছিল না। ও ক্যাম্পাসে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। আমি প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে নির্দিষ্ট জায়গাগুলোয় যেতাম, যেখানে আমরা একসঙ্গে সময় কাটিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও আরিফের দেখা পাইনি।
দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল এক অজানা শূন্যতায়। একদিন হঠাৎ ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের গেট দিয়ে বেরোনোর সময় দেখি আরিফ একটা বাইকে বসে আছে। আমাকে দেখে সে চোখে একটা মিষ্টি হাসি এনে বললো,
“অর্পিতা, অনেক দিন পর দেখা হলো। একটু সময় দেবে?”
আমি কিছু না বলেই ওর বাইকের পেছনে উঠে বসলাম। বাইক ছুটতে শুরু করলো শহরের বাইরে। গাড়ির শব্দে আমরা কথা বলতে পারছিলাম না। কিন্তু বাতাসে আমার মনের উচ্ছ্বাস আর উত্তেজনা মিশে গিয়েছিল। বাইক থামলো শহরের এক নির্জন জায়গায়, যেখানে বড় বড় গাছের সারি আর ছোট্ট একটা পুকুর।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কোনো খোঁজ নাওনি, ফোন নম্বর দাওনি, এমনকি দেখা করতেও আসোনি।”
আরিফ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম কারণ তোমার জীবন আমার থেকে অনেক আলাদা। তুমি অন্য একজন পৃথিবীতে বাস করো, যেখানে শুধুই উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর বাস্তবতা। আর আমার পৃথিবী হলো স্বপ্ন আর ছোট ছোট ভালো লাগার মেলবন্ধন। আমি চাইনি, আমার স্বপ্ন তোমার জীবনের পথে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়াক।”
ওর কথাগুলো শুনে আমার মনটা ভারী হয়ে গেল। বললাম,
“তুমি কী ভেবেছো, আমি তোমার স্বপ্নকে বোঝা ভাববো? আর তোমার কাছে ভালোবাসা মানে কী, আরিফ? হারিয়ে যাওয়া? নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখা?”

আরিফ মাথা নিচু করে বললো,
“না, আমি জানি ভালোবাসা মানে একে অপরের পাশে থাকা। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, যদি তুমি আমাকে ভুলে যাও, তাহলে এটা তোমার জন্য সহজ হবে।”
আমি ওর হাত ধরলাম। গলা ভারী করে বললাম,
“আমি তোমার কথা ভুলতে পারিনি। প্রতিটা মুহূর্তে তোমার কথা ভেবেছি। তুমি কি জানো, তুমি আমার জীবনে এমন কিছু দিয়েছো, যা আগে কখনো পাইনি? তুমি আমাকে জীবনের নতুন রং দেখিয়েছো। তাই তুমি যদি আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবো, তবে তুমি ভুল করছো।”
আরিফ কিছুক্ষণ চুপচাপ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো,
“তাহলে কি তুমি সত্যিই আমাকে তোমার জীবনের অংশ বানাতে চাও?”
আমি বললাম,
“যদি এটা অভিনয়ও হয়, তাহলে সেটাই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে সত্যি অভিনয়।”
ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বললো,
“তোমাকে ছাড়া আমি কোনোদিন সম্পূর্ণ হতে পারবো না।”
এরপর থেকে আমরা দুজনই একে অপরের জীবনের অংশ হয়ে গেলাম। ছোট ছোট আনন্দ, হাসি, এবং অভিমানগুলো আমাদের সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তুলতে লাগলো।
তবে একটা বড় প্রশ্ন সামনে আসছিল। আমাদের পরিবার। আরিফ সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। আর আমি এমন এক পরিবারের মেয়ে, যেখানে বাবা সব সিদ্ধান্ত নেন। ভালোবাসার কথা তাদের সামনে তুলে ধরাটা সহজ ছিল না।
একদিন আরিফ আমাকে বললো,
“অর্পিতা, আমাদের সম্পর্ককে যদি মজবুত করতে হয়, তবে প্রথমে তোমার বাবা-মাকে জানাতে হবে। আমি তাদের সামনে যেতে প্রস্তুত। কিন্তু আগে আমি চাই, তুমি তাদের বোঝাও।”
আমি বুঝতে পারছিলাম, এটাই ছিল আমাদের সম্পর্কের সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়। তবে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাদের ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তাহলে এই বাধাও আমরা পার করবো।
আমার বাবা-মাকে জানানো এবং তাদের সম্মতি নেওয়ার পর্ব ছিল আমাদের জীবনের পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ। কীভাবে এটা সম্ভব হলো? সেই গল্প শুরু হয় নতুন এক মোড় দিয়ে, যেখানে ভালোবাসা আর আত্মবিশ্বাস আমাদের পথ দেখিয়েছিল।