— “ওই পেত্নি! এরকম চিল্লায়ে ক্লাস মাথায় তুলতেছিস কেনো?”
— “আমার ইচ্ছা! আমি চিল্লাবো! তোর সমস্যা কোথায়, বল তো?”
— “জীবনে ভালো হবি না তুই। পাকা ডাইনি!”
— “তুই মনে করিস কী? তুই খুব ভালো? ফালতু একটা সয়তান, গবেট, বুড়া!”
— “ওই! আমারে বুড়া বলিস না! আমি বুড়া না, অভিজ্ঞ!”
— “আহা তাই না? বুড়া তো ফেল খেয়ে এখনো আমাদের সাথেই পড়তেছিস!”
— “দেখ নিপা, বেশি ফাজলামি করিস না। আমি টাইফয়েডে পড়ে এক্সাম দিতে পারি নাই। নয়তো তোদের সবার চেয়ে ভালো ছাত্র ছিলাম আমি! গাধা একটা!”
— “মাসুদ! মুখ সামলে কথা বল, না হলে আমি তোকে খুন করে ফেলবো!”
— “সুটকি মাছ! তুই আমারে খুন করবি? হা হা হা…”
প্রথমে কেবল ঠাট্টা-মশকরা দিয়ে শুরু হলেও, এই ঝগড়া ধীরে ধীরে তীব্র বাকবিতণ্ডায় রূপ নেয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ঝগড়া চাই-ই চাই। ক্লাসের সবাই এখন এদের ঝগড়ার সাথে এতটাই অভ্যস্ত যে, কেউ আর বিরক্ত হয় না—বরং মজা নেয়।
দুজনেই ডিপ্লোমা থার্ড ইয়ারে পড়ে। মাসুদ একটু সিনিয়র, তবে টাইফয়েডের কারণে একটা বছর পিছিয়ে গেছে। সেটা নিয়েও নিপা ওকে সুযোগ পেলেই খোঁচায়।
সাপ আর নেউলের মতো সম্পর্ক—নিপা সবসময় মাসুদের সাজগোজ, পোশাক, পড়াশোনা, এমনকি হাঁটাচলাও সহ্য করতে পারে না। মাসুদও যেন অপেক্ষায় থাকে, কখন নিপার কোন আচরণ নিয়ে ঠাট্টা করতে পারবে।
— “ওই বুড়া! কালকের ইলেকট্রনিক্সের অ্যাসাইনমেন্টটা দে তো, স্যার বলেছে তোর কাছ থেকে নিতে।”
— “আমার তুই লাগে না। ব্যস্ত আছি দেখছিস না? যা এখান থেকে!”
— “ব্যস্ত! মিমের সাথে লুচুমি করাটা এখন তোর কাজ না? লুইচ্চা একটা!”
— “ধীরে বল হারামজাদি! আমি ওর সাথে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়েই কথা বলছি! আর তুই আমারে ব্যাখ্যা দিতে বলিস কেনো?”
— “তোর অ্যাসাইনমেন্ট চাই না! তুই নিজের প্রেম নিয়ে থাক!”
— “তোরে দেখলেই গা জ্বলে আমার!”
— “হুহহ!”
আসলে নিপা মিমকে সহ্য করতে পারে না। কারণটা সরল—অজানা এক দ্বিধায় সে নিজেও বুঝতে পারে না কেনো মিমকে দেখে তার মন খারাপ হয়।
কয়েকদিন হলো, নিপার হাসি-ঠাট্টা অনেক কমে গেছে। মাসুদের চোখে পড়ছে ব্যাপারটা। আগে যেখানে ছোটখাটো কথা নিয়েও ওরা ঝগড়া করত, এখন নিপা কিছুই বলে না। শুধু একটা মুচকি হাসি দিয়ে এড়িয়ে যায়। যেন ভেতরে কোথাও একটা শূন্যতা কাজ করছে।
— “এই তানিয়া, নিপা ক্লাসে আসে না কেনো?”
— “জ্বর হয়েছে ওর।”
— “ও ঠিকমতো মেডিসিন নিচ্ছে তো?”
— “নিচ্ছে হয়তো, আজ কথা হয়নি।”
— “তুই কেমন বন্ধু রে, খোঁজও রাখিস না?”
— “আমিও তো ব্যস্ত ছিলাম।”
ক্লাসে মন বসছে না মাসুদের। মিমের উপস্থিতিও বিরক্তিকর লাগছে আজ। যেন কিছু একটা ঠিকঠাক নেই।
১৪ ফেব্রুয়ারি, সবাই প্রেম-ভালোবাসার দিন উদযাপন করছে। মাসুদের আজ মিমকে প্রপোজ করার কথা। সবাই জানে ব্যাপারটা। কিন্তু মাসুদের মনটা কেমন যেন অস্থির। নিপা যেন আজ অন্যরকম অনুভব হচ্ছে তার কাছে।
তানিয়া জানায়, নিপা লেক পাড়ে বসে আছে।
— “পেত্নি!”
— “…”
— “কিরে তুই চুপ করে আছিস কেনো?”
— “তুই তো মিমের কাছে যাবি। এখানে এসেছিস কেনো?”
— “তোরে মিস করছিলাম।”
— “হাহ! আমাকে কেনো?”
— “তুই তো আমার সব ঝগড়ার কারণ। ঝগড়া না করলে যেন দিনটাই শুরু হয় না।”
— “যা তুই! তোর ভালোবাসা নিয়ে সুখে থাক। আমাকে আর ডাকিস না।”
— “না, আজকে তোকে নিয়েই যাব।”
— “আমি যাবো না।”
— “তাহলে কোলে করেই নিয়ে যাব।”
— “তুই ঐ ডাইনিকে প্রপোজ করবি, সেটা আমি দেখতে পারবো না।”
— “মানে?”
— “মানে আমি তোকেই ভালোবাসি।”
মাসুদের চোখে বিস্ময়।
— “তুই? আমাকে?”
— “হুম… বহুদিন ধরে… কিন্তু বলার সাহস পাইনি।”
— “আমি তো ভাবতাম তুই আমাকে ঘৃণা করিস!”
— “না রে… সব ঝগড়া, খোঁচা, সব ছিলো তোর সঙ্গে কথা বলার একটা অজুহাত।”
— “তাহলে শোন, আমি মিমকে শুধু ব্যবহার করছিলাম… তোকে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু পারিনি। তুই ছাড়া আমার কিছুই পূর্ণ লাগে না।”
নিপার চোখে জল। মাসুদ সাদা গোলাপের একটা গুচ্ছ এগিয়ে দেয়।
— “তোর প্রিয় সাদা গোলাপ। অনেক দিন আগে শুনেছিলাম, তাই মনে রেখেছিলাম।”
— “হুহ! একদম সিনেমার মতো করলি!”
— “তাহলে শুন…”
মাসুদ ধীরে ধীরে বলে উঠলো—
আমি সেই সুতো হবো
যে তোমায় আলোকিত করে
নিজে জ্বলে যাব
আমি সেই নৌকো হবো
যে তোমায় পার করে
নিজেই ডুবে যাবো
হবো সেই চোখ যে তোমায় দেখেই বুঝে যাবে
হবো সেই চাঁদ, যেটা রাত জাগে শুধু তোমার আলো দিতে
আর দিন ফিরলে মিলিয়ে যায়
ভালোবেসো আমায়,
শুধুই আমায়…
নিপা চোখের জল সামলাতে পারেনি। হেসে, কেঁদে, বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে জড়িয়ে ধরে মাসুদকে।
একসময়কার ঝগড়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসা অবশেষে খুঁজে পেল তার নাম—প্রেম।
— “এই পেত্নি! আমার ফোনটা কোথায় রেখেছিস আবার?”
— “তোর মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছি… এখন একটু কষ্ট করে সার্জারি করাইস!”
— “তোর মুখটা সার্জারির দরকার, পুরাই বেয়াদব মেয়েছেলে একটা!”
— “আর তুই পুরা গাধা! প্রেমিক হিসেবে তো বিশাল ফেইল!”
এভাবেই ঝগড়ার মশলা এখনো চলছে। তবে পার্থক্য একটাই—এখন সেই ঝগড়ায় আগুন কম, আর ভালোবাসার রং অনেক বেশি। আগে যেখানে কথা কাটাকাটি শেষে দু’জনেই মুখ ঘুরিয়ে থাকতো, এখন সেখানে ঝগড়ার পর নিপা মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলে মাসুদ চুপিচুপি একটা চকোলেট গুঁজে দেয় হাতে—
— “এই নে, তোর মুড ভালো করার জন্য ‘ম্যাজিক চকো’!”
— “হুম… ফাজিল, কিন্তু ভালোবাসি তোকে…”
কলেজের ক্লাসরুমে এখন আর তাদের ঝগড়াগুলো অশান্তির নয়, বরং সবাই ওদের দেখে মজা পায়।
তানিয়া একদিন বলেই ফেলল,
— “তোদের ঝগড়া না থাকলে তো ক্লাসই বোরিং লাগে এখন!”
মিম? সে এখন একদম বন্ধুর সারিতে। ও নিজেই একদিন নিপাকে বলেছিল,
— “তুই চিন্তা করিস না রে, মাসুদের চোখে তো শুধু তুইই আছিস। ওর সব রাগ, সব ভালোলাগা, সব ঝগড়া—সবকিছুই তোর জন্য।”
একদিন কলেজে ‘কালচারাল ফেস্ট’-এর আয়োজন হলো। সবাইকে জোর করে অংশ নিতে বলা হলো। মাসুদ কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না।
— “আমি গাইতে পারবো না রে পেত্নি, আমি তো আর তোর মত রঙিন পাখি না!”
— “চুপ! আমি যদি আমার গলায় কাকের ডাক বাজিয়ে গাইতে পারি, তাহলে তুইও পারবি।”
শেষমেশ মাসুদ আর নিপা মিলে একটা নাটকে অংশ নেয়—নাটকের নাম, “ঝগড়ার আড়ালে প্রেম”।
সবাই হেসে কুটিকুটি হয়ে যায়, কিন্তু নাটকের শেষে যখন মাসুদ মঞ্চে নিপার দিকে তাকিয়ে বলে,
— “তুই শুধু আমার পেত্নি না, তুই আমার সব—আমার সকাল, আমার রাত, আমার পাগলামো, আমার শান্তি।”
তখন নিপার চোখে টলটল করে জল এসে পড়ে।
নাটক শেষে ফুলের তোড়া নিয়ে মাসুদ হঠাৎ হাঁটু গেড়ে বসে যায়।
— “নিপা, ঝগড়া করব ঠিকই… কিন্তু জীবনভর তোকে ভালোবেসে ঝগড়া করব। আমার হবিস?”
নিপার চোখে জল, মুখে হালকা হাসি।
— “তুই রোজ ঝগড়া করবি তো?”
— “প্রতিদিন। এক কাপ চা আর এক কাপ ঝগড়া—তোর সাথে কাটিয়ে দেব জীবন!”
— “তাহলে হ্যাঁ। আমি তোর পাগলি, তোর পেত্নি, তোর গাধা… সব হতে রাজি।”
“ভালোবাসা সবসময় চুপিচুপি আসে না, কখনো কখনো আসে ঝগড়ার শব্দে, রাগের অভিমানে, আর অদ্ভুত এক অভ্যস্ততায়।”
“মাসুদ আর নিপা তারই এক মিষ্টি উদাহরণ—যেখানে ঝগড়ার আড়ালে লুকিয়ে থাকে অগাধ প্রেম।”