রাত তখন ৮:৩০। ছাদের কোণে বসে সাদিয়া আপন মনে গান শুনছে। ঠাণ্ডা হাওয়া তার লম্বা চুলগুলো উড়িয়ে দিচ্ছে, আর চাঁদের আলো তার মুখে মায়াময় আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্লে লিস্টের মোস্ট ফেভারিট গানটা বাজছে – তাহসানের “প্রেম তুমি আসবে এভাবে, আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি”।
এই গানটা যেন তার জীবনের এক অদৃশ্য আয়না, যেখানে তার না বলা কথাগুলো প্রতিফলিত হয়। হৃদয়ের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সব কিছু ঠিক থাকলে আজ এই গানটা তাকে আনন্দ দিত, কিন্তু এখন এটি তার অতীতের স্মৃতিকে আরও জটিল করে তোলে।
চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে সে হারিয়ে যায় পুরনো দিনগুলোর মাঝে…
সেদিনও ছিল এক জোছনাভরা রাত। হঠাৎ করে ফোনে একটি এসএমএস আসে:
“আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, জোছনা আজ পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে! যতটুকু পারো কিনে রাখো, এমন করে আর কখনো পাবে না। তবে বিল পরিশোধ করতে ভুলো না, কারণ জোছনার মালিক আমি!”
সাদিয়া অবাক হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। অপরিচিত নাম্বার! আবার কেমন পাগলামো টাইপের মেসেজ! কিছুক্ষণ ভেবে বিরক্ত গলায় রিপ্লাই দেয়:
“এই যে মশাই, চাঁদ আমি অনেক আগেই ভ্যাট দিয়ে কিনে রেখেছি! সরকারের কাছে করও দিই। আর আপনি কিভাবে জোছনার মালিক হন? আজব! আমি আপনাকে কেস করবো কিন্তু!”
ফোনের অন্যপ্রান্তেও যে একজন দারুণ হাস্যরসী মানুষ আছে, সেটা তখনও জানত না সাদিয়া।
এসএমএসের আদান-প্রদান চলতে থাকে। এক ঘন্টা পর বিরক্ত হয়ে সাদিয়া সরাসরি কল দেয়। ফোনের ওপাশ থেকে একজন ছেলে খুব শান্ত কণ্ঠে বলে,
“আপনি অবন্তী না?”
সাদিয়া অবাক হয়ে বলে, “না, আমি সাদিয়া। কিন্তু আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”
সাইফ তখন একটু হাসে, “ওহ! তাহলে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আপনার বান্ধবী অবন্তী আমার কাজিন। সে হয়তো ভুল করে আপনার নাম্বার দিয়ে দিয়েছে।”
এভাবে শুরু হয় সাইফ আর সাদিয়ার বন্ধুত্ব। দুজনের মধ্যে প্রতিদিন কথাবার্তা হতে থাকে। গুড মর্নিং, গুড নাইট, সারাদিনের আপডেট – যেন ২৪ ঘণ্টাই একসাথে কাটায় তারা।
সময় গড়িয়ে যায়, বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে গভীর ভালোবাসায় পরিণত হয়।
তাদের ভালোবাসার মধ্যে একটা মিষ্টি প্রতিযোগিতা চলত – কে কাকে বেশি ভালোবাসতে পারে? কে কার যত্ন নিতে পারে বেশি? ঝগড়া কখনোই স্থায়ী হতো না, কারণ দুজনেরই বিশ্বাস ছিল, “আমরা একে অপরকে সারা জীবনের জন্য ছেড়ে যাব না।”
এভাবে কেটে যায় এক বছর। একদিন সাদিয়ার পরিবারকে জানানো হয় সাইফের কথা, আর সাইফের পরিবারও রাজি হয়। সবকিছু ঠিকঠাক, বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে যায়।
বিয়ের মাত্র পাঁচ দিন আগে…
সাইফ বলে, “শপিংয়ের জন্য ঢাকায় যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হবে। চিন্তা করো না, বাসায় পৌঁছে কল দেব।”
কিন্তু সারাদিন কেটে গেলেও কোনো ফোন আসেনি। বিকেলে হঠাৎ সাদিয়ার ফোন বেজে ওঠে, সাইফের নাম্বার থেকে।
“এই ফোনের মালিক আপনার কী হয়?” অপরিচিত কণ্ঠে কেউ বলে।
সাদিয়ার গলা শুকিয়ে আসে, “কে বলছেন? সাইফ কোথায়?”
“এক্সিডেন্ট করেছে, খুব সিরিয়াস। দ্রুত আসুন।”
এই কথা শুনে সাদিয়ার মাথা ঘুরে যায়। বাবা-মা ছুটে আসে। দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছায় তারা, কিন্তু তখনই ডাক্তার জানায়,
“অবস্থা সংকটাপন্ন। যদি বাঁচেও, হয়তো কোমায় চলে যাবে। কিন্তু ভালো যত্ন নিলে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে।”
সাইফ সত্যিই কোমায় চলে যায়। প্রথমদিকে সাদিয়ার পরিবার তাকে দেখতে দিতে চায়নি, কিন্তু সে হার মানেনি। অবশেষে পরিবারের সম্মতিতে সাইফের সঙ্গে তার বিয়ে হয়, হাসপাতালের বিছানাতেই।
সাদিয়া প্রতিজ্ঞা করে, “আমি তোমাকে সুস্থ করব, সাইফ। তোমার ভালোবাসার প্রতিদান দিতে হবে আমাকে!”
পরের তিন মাস দিন-রাত এক করে সাইফের সেবা করে যায় সে। প্রতিদিন সাইফের পাশে বসে গল্প বলে, তার প্রিয় গানগুলো গায়, হাত ধরে ফিসফিস করে বলে, “ফিরে এসো, সাইফ। আমি তোমার অপেক্ষায় আছি।”
একদিন হঠাৎ সাইফের আঙুল নড়ে। তারপর আস্তে আস্তে সে চোখ খুলে তাকায়।
সাদিয়া হতভম্ব হয়ে তার হাত ধরে ফেলে, কান্নায় ভেঙে পড়ে, “তুমি ঠিক আছো? তুমি ফিরে এসেছো!”
সাইফ ক্লান্ত গলায় বলে, “আমি তোমাকে অনুভব করতাম, সাদিয়া। তোমার ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে এনেছে।”
সেই রাতে, বহুদিন পর সাদিয়া ছাদে এসে দাঁড়ায়। হালকা বাতাস বইছে, আর আকাশে পূর্ণিমার আলো ছড়িয়ে পড়েছে।
পেছন থেকে কেউ ধীরে ধীরে তার কাঁধে হাত রাখে।
সে চমকে তাকায়। সাইফ দাঁড়িয়ে আছে, একটু দুর্বল, কিন্তু চোখ দুটো একদম স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল।
“তুমি উঠে এসেছো ছাদে!” কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে সাদিয়া।
সাইফ হাসে, “জানি, তুমি এখানে থাকবে। তাই আর অপেক্ষা করতে পারলাম না।”
তারপর আলতো করে জড়িয়ে ধরে সাদিয়াকে, ফিসফিস করে বলে,
“ঐ দেখো, জোছনা আজও পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। তুমি কি এবার একটু কিনবে?”
সাদিয়া মাথা রাখে সাইফের বুকে, চোখ বন্ধ করে হাসে, আর মনে মনে বলে –
“সারা জীবন তোমার সঙ্গে থাকব, জোছনার আলোয় ভালোবাসায় ডুবে যাব।”
সাদিয়া আর সাইফের জীবন যেন নতুন করে শুরু হলো। হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পরও সাইফ পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। শরীর দুর্বল, হাঁটতে গেলে কষ্ট হয়, মাঝে মাঝে মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু তার পাশে আছে সাদিয়া—একজন নিঃস্বার্থ প্রেমিকা, যে নিজের সবটুকু দিয়ে তাকে আগলে রেখেছে।
সাইফের চোখের দিকে তাকালে সাদিয়া বুঝতে পারে, সে নিজেকে অসহায় মনে করছে। একটা সময় যে ছেলেটা সারাদিন মজা করত, হাসতো, মিষ্টি ঝগড়া করত, আজ সে চুপচাপ বসে থাকে।
সাদিয়া একদিন খুব আদুরে গলায় বলে, “তুমি এখনো আগের মতো কথা বলো না কেন?”
সাইফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “আমি এখন আগের মতো নেই, সাদিয়া। আমি তোমার বোঝা হয়ে যাচ্ছি না?”
এই কথা শুনেই রেগে যায় সাদিয়া। তার চোখে পানি চলে আসে, “সাইফ, তুমি বোঝা না। তুমি আমার পৃথিবী! আমি চাই, তুমি আগের মতো হও। আমি তোমার পাশে থাকব, যত দিন প্রয়োজন।”
সাইফ কিছু বলে না, শুধু সাদিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরে।
সাইফের সুস্থ হতে সময় লাগবে—ডাক্তার আগেই বলেছিল। কিন্তু সাদিয়া হার মানার মেয়ে নয়। প্রতিদিন সে নতুন কিছু করে, যাতে সাইফ আগের মতো হাসতে পারে, বাঁচতে পারে।
একদিন সে বলে, “চলো, কোথাও ঘুরতে যাই।”
সাইফ অবাক হয়, “আমি তো ঠিক মতো হাঁটতে পারি না, কোথায় যাব?”
সাদিয়া হেসে বলে, “আমাদের পুরনো জায়গায়। সেই পার্কে, যেখানে আমরা প্রথম দেখা করেছিলাম।”
সাইফ প্রথমে রাজি হয়নি, কিন্তু সাদিয়ার জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত রাজি হয়।
পার্কে গিয়ে দুজনেই যেন পুরনো দিনে ফিরে যায়। বসার বেঞ্চটা এখনো একই রকম, গাছের ছায়া এখনো স্নিগ্ধ, বাতাস এখনো শান্ত।
সাইফ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর বলে, “জানো, এই জায়গাটা আমার কাছে কতটা স্পেশাল?”
সাদিয়া মিষ্টি হেসে বলে, “কেন? এখানে তো আমরা শুধু গল্প করতাম।”
সাইফ ধীরে ধীরে বলে, “এই জায়গাতেই আমি প্রথমবার বুঝেছিলাম, আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
সাদিয়া চমকে যায়, “তুমি আগে তো কখনো বলোনি!”
সাইফ হেসে বলে, “তুমি জিজ্ঞেস করোনি তো! কিন্তু আজ বললাম।”
সাদিয়ার চোখে পানি চলে আসে। সে সাইফের হাত ধরে বলে, “আমি চাই, তুমি আগের মতো হয়ে যাও।”
সাইফ গভীর চোখে তাকায়, “তাহলে একটা শর্ত মানতে হবে।”
“কি শর্ত?”
“প্রতিদিন আমাকে নিয়ে বাইরে বের হবে, আমার সঙ্গে গল্প করবে, আর আমাকে সবসময় হাসিয়ে রাখবে!”
সাদিয়া হেসে মাথা নাড়ে, “শর্ত মেনে নিলাম।”
সাইফ ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে। আগের মতো প্রাণোচ্ছল হতে সময় লাগবে, কিন্তু সে চেষ্টা করছে।
একদিন সকালে সাদিয়া ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। সাইফ পেছন থেকে এসে তার কাঁধে হাত রাখে, ফিসফিস করে বলে,
“ঐ দেখ, আজও জোছনা পাইকারি দরে বিক্রি হচ্ছে। এবার একটু কিনবে?”
সাদিয়া মিষ্টি হেসে বলে, “কিনবো, তবে এবার পুরোটা কিনবো, সারাজীবনের জন্য!”
সাইফ হাসে, সাদিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
এই ভালোবাসা হারাবে না আর কখনো। তারা একসঙ্গে থাকবেই, প্রতিটি জোছনাভরা রাতে, প্রতিটি সুখ-দুঃখের দিনে… সারাজীবন।
(শেষ)