ভোর ৬টা
“এই তুই উঠবি নাকি? এক বালতি গরম গরম পানি ঢালব হা!”
সকালের শান্ত মুহূর্তটা ধাক্কা খেল। আমি তখনো ঘুমের রাজ্যে ভেসে বেড়াচ্ছি, কিন্তু এই পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝলাম, সর্বনাশ!
“এই না না! কি বলিস তুই! মাথা ঠিক আছে তোর?”
“না নাই! থাম, ঢালছি গরম পানি!”
আমি মুহূর্তের মধ্যে উঠে বসে পড়লাম, চোখ কচলাতে কচলাতে দেখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে—আমার পাগলি আরাধনা। মুখে দুষ্টু হাসি, হাতে পানির বালতি, আর চোখে সেই পরিচিত দুষ্টুমি।
“উফফ আল্লাহ রহম কর আমাকে! এই পাগলিটা একদিন সত্যিই কিছু করে বসবে!” আমি হালকা বিরক্তি ঝরিয়ে বললাম।
আরাধনা এবার হাসতে হাসতে বলল, “যা, এখন ফ্রেশ হয়ে আয়! আমি নাস্তা রেডি করছি!”
আমি ধীর পায়ে বাথরুমের দিকে রওনা দিলাম। একদিকে মন রেগে আছে, আবার এই মেয়েটার জন্য অদ্ভুত একটা ভালোবাসাও কাজ করছে। সে তো আমার শৈশবের বন্ধু, আমার বাড়িরই আরেকটা অংশ। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাকে বলার সাহস পাইনি, “আমি তোকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি!”
টেবিলে বসে নাস্তা খাচ্ছি, এমন সময় মা এসে বললেন,
“কিরে, আজ এত সকালে উঠে পড়লি? কোন অঘটন ঘটল?”
“না কি আর হবে! ওই মহিলা সকাল থেকে আমার ঘুমের বারোটা বাজাচ্ছে!” আমি মুখ বাঁকিয়ে বললাম।
আরাধনা সঙ্গে সঙ্গে বেঁকে বসল, “এই তুই আমাকে মহিলা বললি কেন?”
“তাহলে কি বুড়ি বলব নাকি? বয়স তো কম হলো না তোর!”
“আন্টি দেখো না, তোমার ছেলে আমাকে বুড়ি বলছে!”
মা হাসতে হাসতে বললেন, “তোরা যে! তোদের মধ্যে কবে শান্তি আসবে?”
আমি আরাধনার দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই শুন, কুত্তি! আমি কিন্তু তোর থেকে বড়, তাই রিসপেক্ট দিয়ে কথা বলবি, বুঝলি?”
আরাধনা ভ্রু কুঁচকে বলল, “হুহ, আর তুই বুইড়া বেডা!”
আমি আর কিছু না বলে অফিসের দিকে রওনা দিলাম।
অফিসে কাজের ফাঁকে হঠাৎ ছোটবেলার স্মৃতিগুলো মনে পড়তে লাগল।
আমরা দুজন পাশাপাশি বাড়িতে বড় হয়েছি। আরাধনার কোনো ভাই নেই, আমারও কোনো বোন নেই। তাই দুই পরিবারই আমাদের দুই ভাই-বোনের মতোই দেখেছে। কিন্তু কবে যে এই ভাই-বোনের সম্পর্কটা আমার মধ্যে অন্য কিছু হয়ে গিয়েছে, তা নিজেও জানি না।
আরাধনাকে ছাড়া কল্পনাই করতে পারি না। অফিসে বসে বসে শুধু একটা কথাই মনে হচ্ছিল—এই মেয়েটার সঙ্গে সারাজীবন কাটানোর সুযোগ কি পাব?
বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি, পাগলিটা তার রুমে চিপস খাচ্ছে।
আমি ঢুকেই বললাম, “এই বুড়ি, কি করিস?”
সে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “তোর রক্ত খাবো এখন!”
“এই মেয়ে, কি সব বলিস?”
“দে না, খাই একটু রক্ত!”
“ভাগ শাকচুন্নি!”
“তুই ভাগ! এটা আমার রুম, বুঝলি?”
আমি হাসতে হাসতে বললাম, “আচ্ছা শুন, তোর স্টাডি শেষ হলেই আমরা বিয়ে করব!”
আরাধনা থমকে গেল। চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, “আমরা মানে কারা? কোন দজ্জালনীকে করবি তুই বিয়ে?”
“আমার সামনে একটা বান্দরনি আছে, ওর সাথেই!”
সে সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে বলল, “কি-ই-ই-ই?”
আমি ঠোঁট কামড়ে বললাম, “এই মেয়ে, চিল্লাস না!”
সে মুখ গম্ভীর করে বলল, “তুই কুত্তা! আমি করব না তোকে বিয়ে!”
আমি হালকা মন খারাপ করে বললাম, “না করলে নাই!”
আরাধনা এবার ধমক দিয়ে বলল, “ওহ, তুই আমাকে কষ্ট দিবি?”
আমি মুখ টিপে হাসলাম, “না, মানে তুই তো বললি করবি না!”
সে মুচকি হেসে বলল, “আমার অত্যাচার তুই ছাড়া আর কেউ সইতে পারবে না, সেটাই জানি!”
আমি এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, “এই প্রথম তুই একটা সত্যি কথা বললি!”
সন্ধ্যায় হঠাৎ মা বললেন, “বিয়ে বাড়িতে যেতে হবে!”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “কার বিয়ে?”
মা হেসে বললেন, “ওটা জানার দরকার নেই! তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়!”
আমি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখি, মা-বাবা আর আরাধনার বাবা-মা বসে আছে।
হঠাৎ দেখি, আরাধনা টুকটুকে নীল বেনারসি পরে এসে হাজির।
আমি পুরো থ! যেন চোখের সামনে একটা ডানা কাটা পরী দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ভয়ও কাজ করতে লাগল—আজ তাহলে ওর বিয়ে?
আমার বুক ধকধক করতে লাগল। না, আমি আরাধনাকে কারও হতে দিতে পারব না!
আমি এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললাম, “তুই কারো হতে পারবি না, তুই শুধু আমার!”
সবাই হেসে উঠল। মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “পাগল ছেলে! আজ তোর আর আরাধনারই বিয়ে!”
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আরাধনা মুচকি হেসে বলল, “কুত্তা! অবশেষে তোর মুখ দিয়ে বের হলো!”
আমি নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম, “পাগলি রে, তুই জানিস না, আমি তোকে কতটা ভালোবাসি!”
বাসর রাত
আমি রুমে ঢুকতেই দেখি, আরাধনা বিশাল ঘোমটা দিয়ে বসে আছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম, “এই মহিলা! এত চুপচাপ কেন?”
আরাধনা মিষ্টি হেসে বলল, “আমাকে প্রপোজ কর!”
আমি হাঁ হয়ে গেলাম, “কি বললি?”
“যা বললাম! প্রপোজ কর!”
আমি মুচকি হেসে বললাম,
“এই অসভ্য পাগলি!
তুই কি আমার কোলবালিশ হবি?
তুই কি আমার জীবনের সকাল-বিকেল-রাত হবি?
তোর লিপস্টিক নষ্ট করার অধিকার আমায় দিবি?”
আরাধনা মুচকি হেসে বলল, “আগে লাইটটা অফ কর, হনুমান!”
আমি ঝট করে লাইট অফ করে দিলাম।
আর এখন?
এই গল্পের বাকিটা তো আমাদের, তাই না?
তুমি তো আর অন্যের রোমান্স দেখতে বসোনি, তাই এখন ঘুমোও! 😜
এখন গল্পটা কেমন লাগলো? 😍🔥
সকাল বেলা
বিছানায় শুয়ে আছি, হালকা চোখ খুলে দেখি পাগলিটা আমার পাশেই শুয়ে আছে। ঘুমের মধ্যে মুখটা একদম ছোট বাচ্চাদের মতো নিষ্পাপ লাগছে। মনে হচ্ছে একবার কপালে চুমু খাই, কিন্তু ও জেগে গেলে আবার মারপিট শুরু করবে। তাও সাহস করে কপালে একটা চুমু দিতেই দেখি ওর ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি…
—“এই শুনো… নতুন বর মহাশয়, তুমি কী করছ?” (ঘুম জড়ানো গলায় আরাধনা)
—“কিছু না, আমার বউটা এত কিউট যে একটু আদর করছিলাম।” (আমি)
—“হুম, তাই বুঝি? কিন্তু তুমি তো কোলবালিশ ছিলে, বর না! সারারাত শুধু আমার বালিশ হওয়া ছাড়া আর কিছু করলে না!”
—“এই মহিলা! লজ্জা বলে কিছু আছে? সকাল সকাল শুরু করছ?” (আমি চোখ বড় বড় করে বললাম)
—“উফফ, চুপ করো তো! যাও চা বানিয়ে নিয়ে এসো!”
—“কী? বিয়ের পর বরকে চা বানাতে বলে?”
—“হ্যাঁ! আমার বর তো কোলবালিশ, তাই রান্নাঘরেও কাজ করতে হবে।”
এই পাগলিটাকে নিয়ে আর পারি না! কিন্তু ওর প্রতিটা কথা, প্রতিটা পাগলামো আমার কাছে অমূল্য। তাই উঠে পড়লাম, চা বানানোর জন্য। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি মা হাসছে।
—“কিরে নতুন বর, এত সকালে রান্নাঘরে?” (মা)
—“কিছু না মা, ওই মহিলা সকাল সকাল রাজ্যের হুকুম দিচ্ছে।”
—“হাহাহা, যাক বাবা, এই প্রথম কাউকে পেলাম যে তোর সাথে তোর মতো ব্যবহার করতে পারে!”
চা বানিয়ে নিয়ে আসলাম। আরাধনা তখনও বিছানায় বসে ফোন ঘাটছে।
—“এই নাও তোমার আদরের বর মহাশয়ের হাতের চা।”
—“আহা, বরের হাতের চা! একদম টেস্টি লাগবে!”
আমার সামনে থেকে চা নিয়ে আস্তে আস্তে চুমুক দিলো, তারপর বললো—
—“ইসস, এ কী! এত কড়া বানালি কেন?”
—“হাহাহা, আমি তো ভেবেছিলাম আমার বউটা একটু বেশি মিষ্টি খায়, তাই কম চিনি দিলাম।”
—“আহহ, একদম বাজে বর পেয়েছি! আরেকটা বানিয়ে আনো!”
আমি রাগ দেখানোর জন্য মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, আরাধনা তখন চুপচাপ আমার কাছে এসে আমার হাত ধরলো।
—“এই শোনো… তুমি না অনেক ভালো! আমার জীবনটা না একদম স্বপ্নের মতো লাগছে এখন!”
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। এই প্রথম মেয়েটা এভাবে আবেগ দেখালো! আমি হাসলাম, তারপর ওর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললাম—
—“আমি তোমার স্বপ্ন না, তোমার বাস্তব।”
ও আমার বুকে মুখ গুজে দিলো। সত্যি বলতে, এরকম একটা সকাল চাইছিলাম সারাজীবন ধরে…