একটা নতুন কলেজে ভর্তি হলো অনিক। শহরের প্রান্তে ছিমছাম পরিবেশ, বড় সবুজ মাঠ, আর চারপাশে উঁচু গাছ। প্রথম দিনেই তার চোখে পড়লো মেয়েটি—তিথি। গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, পরিপাটি পোশাক, আর চোখে যেন দুষ্টু ঝিলিক।
প্রথম দিন ক্লাসে স্যারের প্রশ্নের উত্তরে তিথি খুব সহজে কঠিন একটা অঙ্ক সমাধান করলো। অনিক মুগ্ধ। মনের মধ্যে কোথাও যেন একটা কাঁপুনি হলো। কিন্তু সাহস করে কথা বলা তো দূরের কথা, তিথির দিকে তাকানোরও সাহস হলো না।
কিছুদিন পর একটা গ্রুপ প্রজেক্টে তাদের দুজনকেই একসঙ্গে কাজ করতে বলা হলো। তিথি প্রথমে একটু রাগ দেখালেও কাজের মধ্যে যেন দুজনের মধ্যে একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠতে লাগল।
একদিন কাজ করতে করতে তিথি মুচকি হেসে বলল,
“তুমি এত চুপচাপ কেন? সবার মতো তুমিও কি ভাবো আমি খুব অহংকারী?”
অনিক হেসে বলল,
“না, তোমাকে দেখে মনে হয় তুমি খুব বিশেষ একজন। তোমার মতো হতে গেলে বোধহয় চুপচাপ থাকতে হয়।”
তিথি একটু লজ্জা পেল। গ্রুপ প্রজেক্ট শেষ হওয়ার পরও তিথি আর অনিক প্রায়ই কথা বলত। ক্লাস শেষে কলেজের লাইব্রেরিতে বই পড়তে গিয়ে প্রায়ই দেখা হতো। একদিন তিথি মজা করে বলল,
“তুমি এত বই কেন পড়ো? প্রেম করতে ভয় পাচ্ছো নাকি?”
অনিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল,
“না, এমন কিছু না।”
তিথি তখন হেসে বলল,
“আমাকে তো ভয় পাও না, তাই তো?”
অনিক কিছু বলল না। তার বুকের ভেতরে কিছু একটা তোলপাড় হতে লাগল। সেই দিন থেকে তিথির দিকে তার মন আরো বেশি আকৃষ্ট হতে লাগল।
একদিন বর্ষার দিনে কলেজ শেষে তারা দুজন একসঙ্গে বাস স্টপে দাঁড়িয়েছিল। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টি পড়া শুরু হলে তিথি হঠাৎ করে বলল,
“চলো, বৃষ্টিতে ভিজি। এত ভাবনাচিন্তা করলে জীবন চলে না।”
অনিক প্রথমে দ্বিধা করলেও তিথির হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিজতে শুরু করল। সেই দিন যেন তাদের বন্ধুত্ব এক নতুন মোড়ে পৌঁছল। কয়েক মাস কেটে গেল। তিথি আর অনিক প্রায় সব সময়ই একসঙ্গে থাকে। কিন্তু কেউই ভালোবাসার কথা প্রকাশ করতে পারেনি।
একদিন তিথি কলেজের পারফরম্যান্স ডেতে গান গাইছিল। অনিক দূর থেকে দাঁড়িয়ে শুনছিল। তিথির কণ্ঠ যেন মনের গভীর পর্যন্ত ছুঁয়ে গেল। অনুষ্ঠান শেষে তিথি তাকে ডাকল,
“তুমি গান শুনতে পছন্দ করো?”
অনিক মৃদু হেসে বলল,
“তোমার গান শুনতে পছন্দ করি।”
তিথি একটু ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তাহলে আমাকে কখন বলবে?”
অনিক চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
“কী বলব?”
তিথি হেসে বলল,
“যা বলার কথা তোমার চোখে লেখা আছে, তা মুখে বলতে কষ্ট হচ্ছে কেন?”
অনিক বুঝতে পারল, আর লুকিয়ে রাখার কিছু নেই। তিথির হাত ধরে বলল,
“তোমাকে ভালোবাসি। আমার পৃথিবী তুমি।”
তিথি লজ্জায় মাথা নিচু করল, আর বলল,
“তোমাকে ছাড়া আমিও অসম্পূর্ণ। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তিথি আর অনিকের ভালোবাসার গল্প যেন এক নতুন রঙ পেল। তাদের সম্পর্ক আরও গভীর হতে লাগল। কলেজে তাদের বন্ধুরা এখন প্রায়ই মজা করে বলত,
“তোমাদের দুজনকে দেখে মনে হয়, আকাশ আর মাটির মিলন। একে অপরের জন্যই তৈরি।”
তারা একসঙ্গে বই পড়ত, গান শুনত, আর নিজেদের স্বপ্ন নিয়ে কথা বলত। তিথি স্বপ্ন দেখত একজন বিখ্যাত সংগীতশিল্পী হওয়ার, আর অনিক চাইত একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে তাদের ছোট শহরের উন্নতিতে ভূমিকা রাখতে।
তাদের এই সুন্দর সময়ের মাঝেও তিথি প্রায়ই বলত,
“তুমি কি জানো, জীবনে কত কঠিন সময় আসতে পারে? তখন কি এই ভালোবাসা টিকে থাকবে?”
অনিক তখন মৃদু হাসত আর বলত,
“তোমার হাতটা ধরে রাখার জন্যই তো আমি আছি। জীবন যত কঠিনই হোক, আমরা একসঙ্গেই থাকব।”
তিথি মুগ্ধ হয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে থাকত।
তাদের সম্পর্ক যখন নতুন রঙে জমে উঠছে, তখনই প্রথম বাধা এসে দাঁড়াল। তিথির বাবা-মা জানতে পারলেন তাদের সম্পর্কের কথা। তিথির বাবা ছিলেন খুবই রক্ষণশীল। তিনি মনে করতেন, পড়াশোনার সময়ে এমন সম্পর্ক মেয়েদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দেয়।
তিথিকে একদিন ডেকে বললেন,
“তুমি জানো, এই ছেলেটার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ওর সঙ্গে সম্পর্ক রাখলে তোমার জীবন শেষ হয়ে যাবে।”
তিথি চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“বাবা, ও আমাকে ভালোবাসে। ও আমাকে কখনও ভুল পথে নিয়ে যাবে না। আমি নিশ্চিত ও নিজেকে প্রমাণ করবে।”
তবে তিথির বাবা কোনওভাবেই এটা মেনে নিতে রাজি হলেন না।
অনিকও খবরটা শুনল। সেদিন তিথির সঙ্গে দেখা করে সে বলল,
“তোমার পরিবারের কথা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু তুমি কি আমার পাশে থাকবে?”
তিথি তার চোখে চোখ রেখে বলল,
“তোমার হাত আমি কখনও ছাড়ব না। তবে আমাদের এই পথটা সহজ হবে না।”
পরিস্থিতি সামলানোর জন্য অনিক নিজেকে আরও কঠোর পরিশ্রমে নিয়োজিত করল। সে পড়াশোনায় আরও মনোযোগ দিল। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সে বড় শহরে ইন্টার্নশিপ করতে চলে গেল।
তিথির জন্য এটা ছিল খুবই কঠিন সময়। অনিক শহরে চলে যাওয়ার পর তাদের দেখা কমে গেল। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো।
একদিন অনিক ফোনে বলল,
“তিথি, তুমি জানো? প্রতিদিন তোমার মুখটা মনে করে আমি শক্তি পাই। একদিন তোমার বাবাকে দেখিয়ে দেব, আমি তোমার জন্য উপযুক্ত।”
তিথি বলল,
“আমি তোমার অপেক্ষায় আছি। কিন্তু জানি না কত দিন এভাবে পারব।”
অনিক বলল,
“সাধারণ মানুষ কষ্টের কাছে হার মানে। কিন্তু আমরা পারব। কারণ আমাদের ভালোবাসা সত্যি।”
দুই বছর কেটে গেল। অনিক এখন একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার। সে তার কাজ দিয়ে শহরে নাম করে ফেলেছে। একদিন সে তিথির বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
তিথির বাবা প্রথমে অনিককে কিছু বললেন না। কিন্তু অনিক তার কাজের কথা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা সব বিস্তারিতভাবে বলল। সে আরও বলল,
“আপনার মেয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। আমি তাকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি কখনও তাকে কষ্ট দেব না।”
তিথির বাবা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন,
“তোমাকে দেখে বুঝতে পারছি, তুমি সত্যিই মেয়েটার জন্য সঠিক মানুষ। আমি তোমাদের সম্পর্ক মেনে নিচ্ছি।”
এই খবর শুনে তিথি আনন্দে কেঁদে ফেলল।
কিছুদিন পর, তাদের আংটি বদল হলো। সেই বর্ষার দিনের মতোই সেদিন আকাশে হালকা মেঘ ছিল। তিথি আর অনিক একে অপরের হাত ধরে প্রতিজ্ঞা করল—
“জীবনের যেকোনও ঝড় আসুক, আমরা একসঙ্গে থাকব।”
তাদের ভালোবাসার গল্প যেন এক নতুন পথচলার শুরু।