📞 – আপনার নীল রং ভালো লাগে?
👩 – উহু। কালো।
👦 – কেমন মিল দেখুন! আমারও কালো।
👩 – মিথ্যে বলছেন কেন? কালো কি কারও পছন্দের রং হতে পারে?
👦 – তাহলে আপনার হলো কেন?
👩 – আমার হল বলেই বুঝি আপনারও হতে হবে?
👦 – আশ্চর্য তো! কে বলল আপনার পছন্দ বলে আমারও পছন্দ হবে?
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে মেয়েটি। যেন ছেলেটির যুক্তি তার ভাবনার জগতে নতুন এক দোলাচল তৈরি করে। অপর প্রান্তের নীরবতা ভেঙে ছেলেটি বলে ওঠে—
👦 – স্যরি!
👩 – কেন?
👦 – এই যে আপনি রাগ করলেন!
👩 – মোটেও না। (আভিমান লুকানোর ব্যর্থ চেষ্টা!)
👦 – সত্যি?
👩 – হুম! রাগ করলে তো আপনার সাথে আর কথাই বলতাম না। রিসিভার রেখে দিতাম সারা জীবনের জন্য। তারপর আর কখনো আপনার ফোন ধরতাম না!
👦 – বাব্বাহ! এত অভিমান! রাগলে আর কী কী করেন আপনি?
👩 – যার উপর রাগ করি, তার মুখের দিকে তাকাতে পারি না!
ছেলেটি চুপ করে থাকে। হয়তো মেয়েটি জানে না, ছেলেটিও যখন অভিমান করে, তখন তাকাতে পারে না প্রিয়জনের চোখের দিকে।
সেদিন গ্রীষ্মের দুপুরে, যখন মেয়েটি বারান্দায় বসে একমনে পুকুর ঘাটের রাজহাঁসের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখনই হঠাৎ বেজে উঠল ল্যান্ডফোন। একটু চমকে উঠল সে। গতকালও ফোন এসেছিল, কিন্তু কেউ ধরেনি।
📞 – হ্যালো?
👦 – কি ব্যাপার বলুন তো? ল্যান্ডফোনটি কি শুধু সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য রেখেছেন? কাজের জন্য নয়?
মেয়েটি হকচকিয়ে যায়। অপর প্রান্তের কণ্ঠস্বরে একধরনের চেনা উষ্ণতা।
👩 – কেন?
👦 – কাল সারাদিন চেষ্টা করলাম ফোন দেওয়ার, কেউ ধরল না! ল্যান্ডফোনটি যদি জড় বস্তু না হতো, তবে নির্ঘাত বিরক্ত হয়ে নিজেই বলে উঠত!
ছেলেটির অভিযোগ শুনতে শুনতে হঠাৎ মেয়েটির হাত থেকে কয়েকগাছি কাচের চুড়ি পড়ে ভেঙে যায়। শব্দটা ছেলেটির কানেও পৌঁছায়।
👦 – কাকে চাই?
👩 – আপনি আসলে কাকে চাচ্ছেন বলুন তো? হাসান স্যার? তমালিকা ম্যাডাম? নাকি অন্য কাউকে?
👦 – যাকে চাচ্ছি, তার নাম ভুলে গেছি…
মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। অপরিচিত নাম্বার থেকে এই ফোন কলগুলো প্রায়ই আসে, কিন্তু আজকের কণ্ঠস্বরটা যেন কোথাও আটকে যায় তার মনের গভীরে।
📞 – এটা কি সুদীপার নাম্বার?
👩 – নাহ। আর শুনুন, এটা কিন্তু হাসান স্যার বা তমালিকা ম্যাডামেরও নাম্বার না!
👦 – আমি কিন্তু আসল মানুষটাকেই খুঁজছি! সুদীপা!
এই নামটা শুনে মেয়েটি অবাক হয়। গলার স্বর পরিচিত মনে হলেও, সে তো সুদীপা নয়!
👩 – স্যরি, এখানে সুদীপা বলে কেউ থাকে না।
👦 – মিথ্যে বলছেন কেন? আমি জানি, আপনিই সুদীপা!
👩 – বাব্বাহ! তাহলে তো এতদিন নিজের নামটাই ভুল জানতাম!
মেয়েটি রাগ দেখানোর চেষ্টা করলেও ভেতরে কোথাও যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি খেলা করে। অপরিচিত একটা নাম, অথচ পরিচিত এক উষ্ণতা!
ধীরে ধীরে রং নাম্বারের এই ফোন কলটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়।
মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে, কখন ফোন আসবে। ছেলেটিও তার দিক থেকে সময়মতো ফোন দেয়।
কথার পিঠে কথা জমতে থাকে…
👦 – জানেন, আমার বাড়ির বারান্দায় জারুল আর সোনালী সোনালুর গাছ আছে। বেগুনি আর হলুদ ফুলে ঢেকে যায় গাছদুটি!
👩 – সত্যি? তাহলে একদিন আমাকে সেই ফুলগুলো দেখাবেন?
কথাটা বলে ফেলেই মেয়েটি চুপ হয়ে যায়। ছেলেটি হেসে ওঠে, সেই হাসিতে যেন তার সমস্ত ভালোবাসার আভাস লুকিয়ে থাকে।
👩 – জানেন, রবীন্দ্রনাথের ওপর আমার অভিমান আছে!
👦 – কেন?
👩 – ‘শেষের কবিতা’য় অমিত-লাবণ্যকে একসঙ্গে রাখল না কেন?
ছেলেটা হাসে। মেয়েটা লজ্জা পায়! কেন যে কথাটা বলে ফেলল!
এভাবে দিনের পর দিন গড়িয়ে যায়। একদিন হঠাৎ করেই ফোন আসা বন্ধ হয়ে যায়।
মেয়েটি অপেক্ষায় থাকে, কিন্তু কোনো ফোন আসে না।
তারপর অভিমান জমতে জমতে একসময় ভুলেই যায়, প্রতিদিনের সেই ফোন কলটির কথা।
অনেকগুলো মাস পার হয়ে যায়।
একদিন বিকেলবেলা আবার বেজে ওঠে ফোনটি।
📞 – হ্যালো? এটা কি সুদীপার নাম্বার?
মেয়েটি যেন মুহূর্তেই ফিরে যায় পুরনো দিনে। ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে—
👩 – সুদীপা বলে এখানে কেউ নেই।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে ছেলেটি বলে,
👦 – জানি। এটা সুদীপার নাম্বার নয়। কিন্তু আজ ফোন করতেই হলো!
👩 – কেন?
👦 – কারণ, আমি আসল মানুষটাকে খুঁজে পেয়েছি!
মেয়েটি চমকে ওঠে।
ছেলেটি ধীরে ধীরে সব খুলে বলে—
ছেলেটির মা চেয়েছিল, সে যেন এক মেয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়— নাম সুদীপা। ভুল নাম্বারে কল করে একদিন সে মেয়েটিকে খুঁজছিল। কিন্তু খুঁজতে খুঁজতে অন্য এক মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায়।
👦 – জানেন? আমি যখন সুদীপার সঙ্গে দেখা করলাম, তখন বুঝলাম… আমি আসলে সুদীপাকে খুঁজছিলাম না! খুঁজছিলাম আপনাকে!
মেয়েটির চোখে পানি চলে আসে। এতদিন ধরে যে অপরিচিত মানুষটি ছিল, সে-ই আজ সবচেয়ে আপন হয়ে উঠল!
👩 – তাহলে? এখন কী করবেন?
👦 – আপনাকে খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে। এবার যদি ঠিকানাটা না বলেন, তাহলে কিন্তু পুরো শহর খুঁজে বের করব আপনাকে!
মেয়েটি হাসে। যেন এই হাসির অপেক্ষায় ছিল ছেলেটি।
👩 – শহরের উত্তরের শেষ প্রান্তে এক ছোট গলি আছে। গলির মোড়ে তাকিয়ে দেখবেন, সোনালী সোনালু আর জারুল ফুলের নিচে একটা বারান্দা…
ছেলেটি চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে—
👦 – ঠিকানা পেয়ে গেলাম। এবার আর হারাব না!
মেয়েটি ফোন কেটে দেয়, কিন্তু মনে মনে অপেক্ষা করতে থাকে… হয়তো আগামীকালই, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকবে ছেলেটি!
(ল্যান্ডফোনের রিংটোনের গল্প এখানেই শেষ নয়… শুরু মাত্র!)
সেই দিনের পর কেটে গেছে বেশ কয়েকটি মাস। মূর্ছনা আর ছেলেটির কথোপকথন থেমে থাকেনি। এখন আর তাদের মাঝে কোনো ভুল নাম্বারের দেয়াল নেই। পরিচয়ের সব দ্বিধা পেরিয়ে তারা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে একে অপরের কণ্ঠস্বরের সাথে, শব্দের সাথে, অনুভূতির সাথে।
একদিন সন্ধ্যায় মূর্ছনা যখন বারান্দায় বসে বই পড়ছিল, হঠাৎ ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। অবাক হয়ে রিসিভ করতেই চেনা কণ্ঠস্বর—
🔹 “হ্যালো! কী করছিলেন?”
🔹 “বই পড়ছিলাম। আপনার কী খবর?”
🔹 “কিছুক্ষণ বাইরে ছিলেন নাকি?”
🔹 “না তো! আপনি কীভাবে জানবেন আমি কোথায় ছিলাম?”
ছেলেটি হেসে বলল—
🔹 “আজকে আপনার বাড়ির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, বারান্দায় কেউ নেই। ভাবলাম, একটু ফোন করে দেখি!”
মূর্ছনা হতভম্ব!
🔹 “আপনি? আমার বাসার সামনে? সত্যি?”
🔹 “হুম! আপনার বলা ঠিকানা খুঁজে পেতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে! জানেন, এই রাস্তার সবগুলো গলির মোড় দেখতে একইরকম!”
মূর্ছনার বুকের ভেতর ধুকধুক করতে লাগল। রং নাম্বারের সূত্র ধরে যে পরিচয়, সেটাই কি একদিন বাস্তবে এসে ধরা দেবে?
🔹 “আপনি তাহলে আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন?”
🔹 “হয়তো… অথবা হয়তো শুধু নিশ্চিত হতে চেয়েছিলাম, আপনি সত্যি আছেন কিনা!”
মূর্ছনার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি এলো।
🔹 “তাহলে কেমন লাগল?”
🔹 “সত্যি বলতে? বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে বারবার উপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম… কিন্তু কোনো রাজহাঁস বা শালিক পাখি দেখতে পেলাম না!”
মূর্ছনা মুচকি হেসে বলল—
🔹 “ওরা সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে, আমার মতো!”
ছেলেটি তখন এক অদ্ভুত কথা বলল—
🔹 “মূর্ছনা, কখনও কি ভেবেছেন, যদি সেই দিন ভুল নাম্বারে ফোন না যেত, আমাদের কথাগুলো শুরুই হতো না?”
মূর্ছনা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর ধীরে ধীরে বলল—
🔹 “ভেবেছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, যদি একদিন ল্যান্ডফোনের তারটাই ছিঁড়ে যেত, তাহলে কি আপনি আমাকে খুঁজে বের করতেন?”
ছেলেটি গম্ভীর গলায় বলল—
🔹 “সেটা তো জানি না… তবে একটা কথা জানি, কেউ যদি সত্যি কাউকে খুঁজতে চায়, তাহলে হাজারটা ভুল নাম্বারের ভিড়েও সে ঠিকই সঠিক মানুষটাকে খুঁজে নেয়!”
মূর্ছনার বুকের মধ্যে কিছু একটা কেঁপে উঠল। ল্যান্ডফোনের রিংটোনের গল্প কি তবে এখানেই শেষ? নাকি… এটা কেবল শুরু?
🔹 “তাহলে আপনি কি আমাকে খুঁজে পেলেন?”
ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ছেলেটির কণ্ঠস্বর এল, একটু মৃদু, একটু আবেগী—
🔹 “না মূর্ছনা… এখনও খোঁজার পথেই আছি!”