আজ বড়ই বিশেষ দিন। আমরা ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে এসেছি। বাবা চেয়েছিলেন ইসলামিক পরিবেশ থেকে একটি মেয়ে হোক, তবে এতটা ধর্মপ্রাণ পরিবার হবে, সেটা আমার জানা ছিল না। আমি যথেষ্ট শালীন পোশাকে এসেছি—সালোয়ার কামিজ, মাথায় ওড়না টানা। তবুও পাত্রীর বাবা আর ভাই আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলেন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলা, যিনি সম্ভবত পাত্রীর মা, বোরকার আড়াল থেকে শান্ত গলায় বললেন,
— আপনি ভেতরে এসে বসুন, মা।
তার ভদ্রতা এবং বিনয় আমাকে খানিকটা লজ্জায় ফেলে দিল। ভিতরে ঢুকে দেখলাম, খাটের ওপর বোরকা পরিহিত একটি মেয়ে বসে আছে, চোখ দুটো ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেও নীরবে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হলো, যেন একটা রহস্যময় জগতে ঢুকে পড়েছি।
এমন সময় হঠাৎ করে দশ-এগারো বছরের একটি ছোট ছেলে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে লাগল। আমি দ্রুত বললাম,
— তুমি কোথায় যাচ্ছো এভাবে?
ছেলেটা মাথা নিচু করে জবাব দিল,
— আপনি সম্পূর্ণ পর্দায় নেই, আমি আপনাকে এভাবে দেখতে পারি না। দৃষ্টির হেফাজত করা আমার নৈতিক দায়িত্ব।
তার কথাগুলো শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এতোটুকু একটা ছেলে, অথচ কী গভীর বিশ্বাস তার মনে!
আমি মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম,
— আপনিই কি পাত্রী?
সে মাথা নিচু করেই মৃদুস্বরে বলল,
— জ্বী।
আমি ইতস্তত করে বললাম,
— আপনার চেহারাটা দেখতে পারি?
সে দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ধীরে ধীরে নিকাব সরিয়ে দিল। আমি হতবাক হয়ে গেলাম! যেন চাঁদের আলো ঘরের ভেতর ছড়িয়ে পড়েছে। তার ত্বকের উজ্জ্বলতা, চোখের গভীরতা, ঠোঁটের কোমলতা—সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি কোনো বাস্তব মানুষ না, বরং এক স্বর্গীয় সৌন্দর্যের সামনে বসে আছি।
আমি অস্ফুট কণ্ঠে বলে ফেললাম,
— মানুষ এত সুন্দর হয়!
সে মৃদু হাসল। কী অসম্ভব মায়াময় সেই হাসি! তারপর শান্ত গলায় বলল,
— আল্লাহর সব সৃষ্টি-ই সুন্দর, ভাইজান।
তার কণ্ঠ শুনে মনে হলো, এ কেবল সৌন্দর্যের বাহারি চেহারা নয়, বরং এক পরিপূর্ণ আত্মার উজ্জ্বলতা। আমি ধীরে ধীরে বললাম,
— আপনার নাম কী?
— ফাতেমা।
আমি মনে মনে বললাম, নামের মর্যাদা তুমি রেখেছো, আপু!
কিন্তু হঠাৎ একটা অস্বস্তি আমাকে গ্রাস করল। আমার ভাই তো নিয়মিত নামাজও পড়ে না, ইসলামি আদর্শ থেকেও অনেক দূরে। এমন নিষ্পাপ একটা মেয়ের সাথে তার বিয়ে হওয়া উচিত কি? আমি দ্বিধা কাটিয়ে ফাতেমাকে বললাম,
— আপনি জানেন, আমার ভাই নামাজ-কালাম ঠিকমতো পড়ে না? সে অনেকবার প্রেমে পড়েছে, অনেক মেয়ের সাথে মিশেছে। আপনি তবুও তাকে বিয়ে করতে রাজি?
ফাতেমার চোখে কোনো পরিবর্তন দেখলাম না। বরং সে গভীর আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
— জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে সব আল্লাহর হাতে। তিনি আমাকে যার জন্য সৃষ্টি করেছেন, আমি তাঁরই হবো। যদি আপনার ভাই হন, তবে আমি সানন্দে তাঁর সহধর্মিণী হবো। আর যদি আল্লাহ আমাকে অন্য কারো জন্য নির্ধারণ করে থাকেন, তাহলে কোনো শক্তিই এই বিয়ে সম্পন্ন করতে পারবে না।
তার কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেল। এত দৃঢ় বিশ্বাস! এত আত্মসমর্পণ আল্লাহর কাছে!
সেদিনই বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল।
আজ ভাইয়ার বিয়ে। বাড়িতে উৎসবের আমেজ, অথচ পাত্রীর বাড়িতে তেমন কোনো জাঁকজমক নেই। মেয়েটি তখনো বোরকায় ঢাকা, যেন সে নিজের সৌন্দর্যকে কেবল একজনের জন্যই সংরক্ষণ করে রেখেছে।
বৌকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর, ভাবী (ফাতেমা) আমার কাছে এসে মৃদু গলায় বললেন,
— আমার একটা অনুরোধ ছিল।
— কী বলো?
— আমি পরপুরুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবো না। তুমি কি দয়া করে আমাকে আমাদের রুমটা দেখিয়ে দেবে?
আমি চুপচাপ তাকে রুমে নিয়ে গেলাম। তারপর যখন সব অতিথি চলে গেল, আমি ভাবীর রুমে গেলাম। ঘরে ঢুকতেই থমকে গেলাম! ভাবী আজ সত্যিকারের নববধূর সাজে সেজেছেন। নিকাব সরিয়ে শুধু ভাইয়ার জন্য তাঁর সৌন্দর্য উন্মোচন করেছেন।
আমি বিস্ময়ে বললাম,
— ভাবী, তুমি এত সুন্দর করে সেজেছো?
সে মৃদু হাসলেন,
— মেয়েদের জন্যই তো সাজগোজ। তবে সেটা স্বামীর জন্যই হওয়া উচিত। স্বামী যখন স্ত্রীর রূপে মুগ্ধ থাকে, তখন আল্লাহও সন্তুষ্ট হন।
আমি মনে মনে বললাম, ভাইয়া কী লাকি!
ভাবী আসার পর পুরো বাড়িটাই যেন পাল্টে গেল। তিনি কাউকে জোর করলেন না, তবুও সবার মধ্যেই পরিবর্তন আসতে থাকল। প্রথম প্রথম শুধু নামাজের জন্য অনুরোধ করতেন, পরে আমরা নিজেরাই নামাজ না পড়লে অস্বস্তি বোধ করতাম।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এলো ভাইয়ার মধ্যে। আগে যিনি অশ্লীল ওয়েবসাইটে ঘুরে বেড়াতেন, তিনিই এখন তাহাজ্জুদের নামাজে দাঁড়ান। যে অফিস ভাইয়াকে দাঁড়ি কাটতে বলেছিল, তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিলেন। এখন কম বেতনের হলেও শান্তির চাকরি করছেন।
আজ আমার বিয়ে! সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো, আমার সেই প্রেমিকই আমার জীবনসঙ্গী, তবে চার বছর কোনো যোগাযোগ ছিল না।
একদিন মাঝরাতে যখন আমি তার সাথে ফোনে কথা বলছিলাম, ভাবী তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে এসে আমার পাশে দাঁড়ালেন। আমি চমকে গিয়ে ফোন রেখে দিলাম।
ভাবী শান্ত গলায় বললেন,
— আত্মহত্যা পাপ, জানো?
আমি অবাক হয়ে বললাম,
— মানে?
— তুমি কি তোমার ভিতরের মুমিন সত্তাকে হত্যা করছো না? তুমি কি জানো, বিবাহপূর্ব প্রেম ইসলামে নিষিদ্ধ?
আমি মাথা নিচু করে ছিলাম।
ভাবী বললেন,
— তুমি যদি তাকে ভালোবাসো, তাহলে তাকে সবর করতে শেখাও। আল্লাহ তোমাদের মিলন নির্ধারণ করে রেখেছেন, তবে সঠিক পথে। যদি সে সত্যি ভালোবাসে, সে অপেক্ষা করবে।
সেদিন তার কথাগুলো হৃদয়ে গেঁথে গিয়েছিল। আমি তার কথা মেনে নিয়েছিলাম, আর আজ আমি আমার প্রিয় মানুষটিকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পেলাম, তবে শুদ্ধতম পথে।
কাজি দোয়া পড়াচ্ছেন। আমি বোরকায়, আর সে পাঞ্জাবি-টুপি পরে বসে আছে।
নিঃসন্দেহে, এ পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দৃশ্যগুলোর একটি!
গল্পটাকে আমি আরও আবেগপ্রবণ, বাস্তবসম্মত এবং হৃদয়স্পর্শী করার চেষ্টা করেছি। কেমন লাগল বলো! 😊
আজ বিয়ের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে সময় লাগলেও, মনে হচ্ছে যেনো একটা শান্তির রাজ্যে বাস করছি। সংসারে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, ও ইবাদতের ছায়া যেন সবসময় বিরাজমান।
বিয়ের পর প্রথম কয়েকদিন একটু সংকোচে ছিলাম। আমার স্বামী, আহমেদ, আমাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে। কখনো জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয় না, সবসময় আমার স্বস্তির দিকে খেয়াল রাখে। প্রথম রাতে সে আমাকে বলেছিল—
“আমি জানি, তুমি কিছুটা লজ্জিত অনুভব করছো। আমি চাই না তুমি কোনো কিছুর জন্য অস্বস্তি বোধ করো। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, যেন আমরা একে অপরের জন্য রহমত হয়ে উঠতে পারি।”
এই কথাগুলো শুনে আমি অবাক হয়েছিলাম। এখনকার দিনে কজন পুরুষ স্ত্রীর সম্মানের কথা ভাবে? আমি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলাম, এত সুন্দর মনের একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার জন্য।
আমার জন্য আহমেদ নিজেকে বদলে নিয়েছে। আগে সে হয়তো সিনেমা, গান এসব দেখতো, কিন্তু এখন সময় পেলেই কুরআন তিলাওয়াত করে। আমাদের মাঝে এক নতুন ধরণের ভালোবাসা গড়ে উঠেছে—একটা পবিত্র ভালোবাসা, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত।
আমাদের ঘরটাও ধীরে ধীরে বদলে গেছে। আগের মতো টেলিভিশনে নাটক-সিনেমা চলে না, এখন কুরআনের তিলাওয়াত আর ইসলামিক আলোচনা শোনা হয়। কেউ কারও ওপর কিছু চাপিয়ে দেয়নি, কিন্তু আল্লাহর রহমতে সবার মনেই যেন পরিবর্তন চলে এসেছে।
ভাবীর প্রভাব আমাদের পরিবারের সবার ওপরই পড়েছে। সে আমাদের ঘরে আসার পর থেকেই সবাই সময় মতো নামাজ পড়তে শুরু করেছে। আম্মু-আব্বু এখন নিয়মিত তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ে, ছোট ভাইটাও নামাজের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে।
একদিন আব্বু আমাকে বললেন—
“তোমার ভাবী আমাদের শুধু একটা জিনিসই শিখিয়েছে, আল্লাহকে ভালোবাসতে। আর যখন আল্লাহকে ভালোবাসতে শেখা যায়, তখন সবকিছুতেই পরিবর্তন চলে আসে।”
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম, সত্যিই তো! যদি আমাদের জীবনের প্রতিটা সিদ্ধান্ত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়, তাহলে কি আমাদের দুঃখ থাকে?
একদিন বিকেলে আমি জানালার পাশে বসে ছিলাম। আহমেদ এসে আমার পাশে বসল। বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললো—
“তুমি কি কখনো ভাবতে পেরেছিলে, আমরা এত সুখী হবো?”
আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে না বললাম।
হঠাৎ আহমেদের মুখটা একটু গম্ভীর হয়ে গেলো।
“আমি তোমাকে একটা কথা বলবো, হয়তো শুনে তোমার খারাপ লাগবে। কিন্তু সত্য বলাটা জরুরি।”
আমি চমকে উঠলাম। কি এমন কথা বলবে?
“আমার জীবনে এর আগে একটা ভুল ছিলো। আমি আগে একটা মেয়েকে ভালোবাসতাম। কিন্তু সেটা ভালোবাসা ছিলো না, শুধুই একটা মোহ। আল্লাহর পথে আসার পর আমি বুঝতে পারি, ভালোবাসা তখনই পূর্ণতা পায় যখন তা বৈধ হয়। আমি চাই তুমি আমার জীবনে নতুন শুরুর প্রতীক হও।”
আমি গভীরভাবে আহমেদের দিকে তাকালাম। তার চোখে সত্যতা দেখতে পেলাম। সে যা বলেছে, তা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করা যায়।
আমি মৃদু হেসে বললাম, “আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে নিয়ে এসেছেন, এটাই বড় বিষয়।”
আহমেদ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। আমি অনুভব করলাম, ভালোবাসা শুধু শারীরিক আকর্ষণ নয়, বরং পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা।
বিয়ের ছয় মাস পর আমি নতুন এক অনুভূতি টের পেলাম। আমার শরীরে এক নতুন প্রাণের অস্তিত্ব। আমি মা হতে চলেছি!
আহমেদকে খবরটা দেওয়ার পর সে যেন আনন্দে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। আল্লাহ আমাদের এত বড় নেয়ামত দিয়েছেন, ভাবতেই চোখে পানি চলে এলো।
আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বললো—
“আমি চাই, আমাদের সন্তান আল্লাহভীরু একজন মানুষ হয়ে বড় হোক। আমি চাই, সে যেন আমাদের চেয়েও বেশি আল্লাহর পথে চলতে শিখে।”
আমি চোখের জল মুছে বললাম, “ইনশাআল্লাহ, আমরা দুজন মিলে তাকে ইসলামিক আদর্শে বড় করবো।”
আমাদের ভালোবাসা এখন আর শুধু দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমাদের ভালোবাসা এখন এক নতুন জীবনের রূপ নিতে চলেছে।
আমি একসময় ভাবতাম, ভালোবাসা মানেই রঙিন স্বপ্ন, মিষ্টি কথাবার্তা, একসাথে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটানো। কিন্তু আজ বুঝি, ভালোবাসার আসল রূপ হলো একে অপরকে আল্লাহর পথে ধরে রাখা, হারিয়ে যেতে না দেওয়া।
আমার সংসার শুধু দুনিয়ার নয়, আখিরাতের জন্যও তৈরি হচ্ছে। আমি জানি, আমাদের পথ সহজ নয়, অনেক চ্যালেঞ্জ আসবে। কিন্তু আমি দৃঢ় বিশ্বাসী, যদি আমরা আল্লাহর ওপর ভরসা করি, তাহলে সব বাধাই আমরা পেরিয়ে যেতে পারবো।
(সমাপ্ত)