প্রতিদিনের মতো আজও রাহুল কলেজে যাচ্ছে (সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে)। রাহুল কলেজে প্রবেশ করতেই “এই যে ভাইয়া শুনুন” বলে কে যেন ডাকছে বারবার। ফিরে দেখে একটা মেয়ে ডাকছে।
রাহুল: (নিজের দিকে আঙুল দেখিয়ে) আমাকে ডাকছেন? মেয়ে: হ্যাঁ, আপনাকেই ডাকছি। নিজেকে কী মনে করেন আপনি? আজকের পর থেকে মায়ের ক্লাসে আর পড়া দেবেন না বুঝেছেন। রাহুল: কী বলছেন? ক্লাসে পড়া দেবো না মানে? আর কে আপনার মা বা? মেয়ে: এই ছেলে! বলে কী… যে মেয়েকে কলেজের সব স্টুডেন্ট নীলা ম্যাডামের মেয়ে এক নামে জানে, আর আপনি কিনা আমায় চেনেন না! কোথায় থাকেন আপনি? মঙ্গল গ্রহে? রাহুল: আমি মঙ্গল গ্রহে থাকি আর যেখানেই থাকি… আপনার কথা শুনবো কেন? মেয়ে: আপনার জন্যই আমাকে প্রতিদিন মায়ের কাছ থেকে বকা খেতে হয়। সেটা কি আপনি জানেন?
এমন সময় মেয়েটির কয়েকজন বান্ধবী এসে বলল: “এই মীরা, এখানে কী করিস? চল, চল ক্লাসে যাবো।” তারপর মেয়েটি চলে গেল। রাহুল ভাবছে, “মেয়েটি তো অনেক সুন্দর।”
রাহুল ক্লাসে চলে গেল। নীলা ম্যাডাম রাহুলকে অনেক পছন্দ করে। আর পছন্দ করবেই না বা কেন—পড়ালেখা, খেলাধুলা, দেখতে সবকিছুতেই এত ভালো যে কল্পনারও বাইরে। নীলা ম্যাডামের ক্লাসের সময় রাহুলের মনে পড়ে যায় ম্যাডামের মেয়ের কথা। ক্লাস শেষে রাহুল তার এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে নীলা ম্যাডামের মেয়ের কথা।
রাহুল: তুই কি মীরার কথা বলছিস? হৃদয়: নাম জানি না, তবে তার বান্ধবীরা মীরা বলে ডাকছিলো। রাহুল: বন্ধু, প্রেমে পড়ে গিয়েছিস না তো? ওহ হো, পার্টি দিবি না?
রাহুল: আরে বন্ধু না। মেয়েটি আমায় আজকের পর থেকে নীলা ম্যাডামের ক্লাসে পড়া দিতে বারণ করছে, তাই তোর কাছ থেকে জানতে চাইলাম।
হৃদয়: ওহ… দোস্ত, নীলা ম্যাডামের মেয়ে কিন্তু খানিকটা রাগী ও জেদি। কয়েকদিন আগে একটা ছেলে প্রপোজ করায় তার এমন হাল করেছে যে এখন আর মীরার দিকে চোখ তুলে তাকায় না।
রাহুল: তাই না কি? হৃদয়: হ্যাঁ রে দোস্ত, ঐ মেয়েটির থেকে সাবধানে থাকিস।
ক্লাস শেষ করে বাসায় যাচ্ছি… কলেজ গেটের সামনে মীরা দাঁড়িয়ে আছে।
মীরা: এই যে মিঃ, আপনাকে না ক্লাসে পড়া দিতে মানা করছি। তাহলে পড়া দিলেন কেন? আপনি জানেন, আজকে মা আমায় পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছিল আপনার জন্য।
রাহুল: আজব তো… আমার জন্য আপনাকে কেন দাঁড় করিয়ে রাখবে? নিশ্চয়ই আপনি পড়াশোনা করে আসেননি। মীরা: এর পর থেকে আর মায়ের ক্লাসে পড়া দিলে… আপনার অবস্থা খারাপ করবো, বুঝলেন?
রাহুল: আপনি আমার সাথে এমন করলে ম্যাডামকে বলে দিবো কিন্তু।
মীরা: বলে দিলেও কিন্তু আপনার অবস্থা খারাপ আছে বলে দিলাম।
পরেরদিন কলেজে গিয়ে ম্যাডামকে এসব বলে দেয় রাহুল। সেদিন বাসায় গিয়ে ম্যাডাম মীরাকে অনেক বকা দেয়।
তারপর একদিন মীরা রাহুলকে বাজারের পাশে দেখতে পেয়ে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলছে, “ছাড়ুন আমাকে, বাঁচাও বাঁচাও।” চিৎকারের শব্দ শুনে অনেক লোক ছুটে আসে আর রাহুলকে মারতে শুরু করে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জ্ঞান ফিরার পর নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করলো। পাশে রাহুলের মা বসে কাঁদছে। রাহুলের চোখ দিয়েও যেন অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে।

রাহুল: মা, বিশ্বাস করো মেয়েটি আমাকে ফাঁসিয়েছে। রাহুলের মা: চুপ, একদম চুপ! তোকে এতোদিন এতো কষ্ট করে মানুষ করলাম আর তার প্রতিদান তুই এভাবে দিলি? তোকে আমার সন্তান ভাবতেও লজ্জা লাগছে। ছি ছি ছি!
মায়ের কথা শুনে কেঁদেই দিল রাহুল। কিছুক্ষণ পর মা-কে সবকিছু বলে জড়িয়ে ধরে কাঁদে রাহুল।
এদিকে মীরা ভাবছে, “আজকে রাহুলের সাথে আমি এটা ঠিক করিনি।” নিজেকে অনেক বড় অপরাধী ভাবছে আর কান্না করছে। কান্না করে সারারাত পার করে দিল মীরা। মীরা মনে মনে ঠিক করলো, “আমাকে ওর কাছ থেকে যেভাবেই হোক সরি বলতে হবে।”
আজ ২ দিন পর হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরল রাহুল। রাহুল ভাবছে, ঐ কলেজে আর পড়বে না। সিদ্ধান্ত নেয় মামার বাড়ি থেকে ওখানে কোনো কলেজে পড়বে। নীলা ম্যাডামকে মা বিষয়টা জানায়।
নীলা ম্যাডাম: মীরা, তুমি এতটা নিচ ও জঘন্য আমার জানা ছিল না। তোমাকে সন্তান বলতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে। মীরা: মা, আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও। নীলা ম্যাডাম: জাস্ট শাটআপ! তোমার কোনো কথাই শুনতে চাই না। আমি তোমাকে ক্ষমা করবো কেন? যার কাছে অন্যায় করেছো, তার কাছে ক্ষমা চাও।
কয়েকদিন পর… রাহুল কলেজে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য রাস্তা দিয়ে হেঁটে হেঁটে কলেজে যাচ্ছে। এমন সময় মীরা পিছন থেকে রাহুলকে ডাক দিল। মীরা: এই যে, একটু থামবেন প্লিজ? রাহুল পিছন ফিরে দেখলো, সেদিন যে মেয়েটি তাকে পাবলিক হাতে মার খাইয়েছে সে। মেয়েটিকে দেখে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। মীরা রাহুলের সামনে পথ আটকিয়ে দাঁড়ায়।
মীরা: আমি আসলে সরি সেদিনের জন্য। রাহুল: আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি বলুন তো, আমার সাথে এমনটা করছেন? মীরা: …… এবার মীরা তার দুই হাত দিয়ে দুই কান ধরলো আর কান ধরেই বলল… মীরা: সরি। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
মীরা রাহুলের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাহুল নিশ্চুপ থাকা দেখে মীরা বলে: মীরা: প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন? (কান ধরা অবস্থায়) আমি বুঝতে পারিনি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আপনি আমাকে ক্ষমা না করলে আমি কোনোদিনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। (এবার কেঁদেই দিল মীরা)
রাহুল: এসব ন্যাকামি বন্ধ করুন। আমি ভগবান নই যে আপনাকে ক্ষমা করবো।
বলে পাশ কাটিয়ে কলেজ গেল রাহুল। এদিকে মীরা ওখান থেকে চোখ মুছতে মুছতে বাসায় চলে গেলো।
দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। রাহুল আর কলেজে যায়নি। সে মামার বাড়িতে চলে গিয়েছে এবং নতুন কলেজে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু মন যেন কিছুতেই স্থির হচ্ছে না। মায়ের সাথে সম্পর্ক আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। তার মন পড়ে থাকে পুরোনো সেই জায়গায়, পুরোনো সেই মানুষগুলোর সাথে।
অন্যদিকে, মিরা যেন একদম বদলে গেছে। কলেজের সবাই অবাক হয়ে দেখছে, এই মেয়েটা আর আগের মতো জেদি বা রাগী নেই। সবসময় চুপচাপ থাকে, কারও সাথে তেমন কথা বলে না। ক্লাসে মন বসে না তার। শুধু মনে হয়, রাহুলের সাথে দেখা করতে হবে—কীভাবে ক্ষমা চাইবে, সেই চিন্তায় পাগলপ্রায়।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে নীলা ম্যাডাম মিরাকে ডাকলেন।
নীলা ম্যাডাম: “মিরা, আমার সাথে একটু চলো।”
মিরা কিছু না বলে মায়ের পিছু নিল।
নীলা ম্যাডাম ওকে নিয়ে তাদের বাড়ির উঠোনে বসলেন।
নীলা ম্যাডাম: “তোমার কী হয়েছে মিরা? কয়েকদিন ধরে তোমাকে একদম অচেনা লাগছে। ক্লাসে মন নেই, হাসি নেই। এত চুপচাপ থাকো কেন?”
মিরা চোখের পানি সামলাতে পারল না। সবকিছু মায়ের কাছে খুলে বলল।
মিরা: “মা, আমি খুব বড় ভুল করেছি। রাহুল আমার জীবনের প্রথম মানুষ যে আমার চোখে চোখ রেখে সত্যি কথা বলেছিল। অথচ আমি ওর সাথে এতটা অন্যায় করলাম। মা, আমি কি সত্যি এত খারাপ?”
নীলা ম্যাডাম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
নীলা ম্যাডাম: “খারাপ হতে পারো, মিরা। কিন্তু খারাপ থাকাটা তোমার হাতে। যদি সত্যিই নিজের ভুল বুঝতে পারো, তাহলে সেই ভুলটা শুধরে নাও। রাহুল কোথায় থাকে জানি না। কিন্তু তাকে খুঁজে বের করাই এখন তোমার দায়িত্ব।”
মিরা মায়ের এই কথাগুলো শুনে চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল।
মিরা: “হ্যাঁ, মা। আমি ওর সাথে দেখা করব। ওর কাছে মাফ চাইব।”
এক মাস পর:
রাহুল নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে। পড়াশোনায় মন বসানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু মাঝে মাঝে পুরোনো স্মৃতিগুলো ভেসে আসে। মিরার সেই সরি বলা মুখটা ভুলতে পারছে না। তার কাছে এই ঘটনাগুলো যেন একটা দুঃস্বপ্ন।
একদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে সে দেখে, দূরে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাহুল প্রথমে পাত্তা না দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু মেয়েটি তার সামনে এসে দাঁড়াল।
মিরা: “আমি কি একটু কথা বলতে পারি?”
রাহুল কিছু না বলে মিরার দিকে তাকাল।
রাহুল: “কেন? এবার কী চাও?”
মিরা: “কিছু চাই না। শুধু একটা কথা বলতে এসেছি।”
মিরা একটা কাগজ রাহুলের হাতে দিল।
মিরা: “এটা পড়লেই সব বুঝতে পারবে। তারপর চাইলে আমাকে কখনো দেখতে হবে না।”
রাহুল কাগজটা খুলে পড়তে লাগল।
চিঠি:
“প্রিয় রাহুল,
তোমার সাথে পরিচয়টা হয়তো খুব একটা ভালোভাবে শুরু হয়নি। কিন্তু জানো, সেই দিনগুলোতেই আমি প্রথমবার কারও চোখে সত্যিকারের সৎ একজন মানুষ দেখেছিলাম। তোমার প্রতি অন্যায় করার পর থেকে আমি নিজেকে আর শান্তি দিতে পারিনি। যেদিন তোমাকে অন্যায়ভাবে হেনস্তা করিয়েছিলাম, সেদিন থেকে আমি প্রতিনিয়ত অনুশোচনার আগুনে জ্বলছি।”
“আমি জানি, তুমি আমাকে হয়তো কোনোদিন ক্ষমা করবে না। তবু আমি চাই, তুমি সুখে থাকো। আর যদি কখনো মনে করো, আমি তোমার বিশ্বাস অর্জনের যোগ্য, তাহলে একবার আমাকে সুযোগ দিয়ো।”
— মিরা।
রাহুল চিঠিটা পড়ে মিরার দিকে তাকাল।
রাহুল: “এত কিছু করেও তুমি আশা করো আমি তোমাকে ক্ষমা করব?”
মিরা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, “জানি না। কিন্তু চাই।”
রাহুল গভীর নিশ্বাস ফেলল।
রাহুল: “ঠিক আছে। একটা সুযোগ দিলাম। কিন্তু মনে রেখো, এটা তোমার শেষ সুযোগ।”
মিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তুমি আমার এই বিশ্বাস রাখো। আমি তোমার আস্থা ফিরে পাবই।”
সেদিন থেকে মিরা রাহুলের জীবনে পরিবর্তন আনার জন্য নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। ধীরে ধীরে রাহুলের বিশ্বাস ফিরতে শুরু করে। দুজনের মধ্যে আবার বন্ধুত্ব তৈরি হয়।
একদিন বিকেলে রাহুল আর মিরা কলেজের মাঠে বসেছিল।
রাহুল: “মিরা, জানো? জীবনে কেউ যদি সত্যি করে পরিবর্তন করতে পারে, সেটা শুধু মনের ইচ্ছা দিয়েই সম্ভব। তোমার জন্য আমি নতুন করে ভাবতে শিখেছি।”
মিরা হেসে বলল, “তাহলে কি বন্ধু থেকে একটু বেশি হওয়া যায়?”
রাহুল মুচকি হেসে বলল, “দেখা যাক।”
এভাবেই তাদের সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে ভালোবাসায় রূপ নিতে শুরু করল। দুইজনই একে অপরকে বুঝতে শিখল, এবং মনের গভীর ক্ষতগুলো একসাথে সারিয়ে তুলল।
শেষে, ভালোবাসাই তাদের জীবনকে নতুন দিগন্তে নিয়ে গেল।