– মিশু, হোমওয়ার্ক দেখাও?
ছোট্ট ছেলেটা মোবাইলে গেম খেলছে, যেন আমার কথায় কানই দিচ্ছে না।
– এই মিশু, তোমাকে বললাম হোমওয়ার্ক দেখাতে!
– জ্বি দুলাভাই, হোমওয়ার্ক তো করি নাই।
– কী? করো নাই মানে? আর তুমি আমাকে কী বলে ডাকলে?
– দুলাভাই বলেছি।
আমি রাগে ঠোঁট কামড়ে ধরলাম।
– ফাজলামি করছো? তোমার আম্মুকে বলতে হবে তাহলে!
– আম্মুকে কেন বলবেন? আপুই তো বলেছে আপনাকে দুলাভাই ডাকতে!
আমি একটু থমকালাম।
– কোথায় তোমার আপু?
– ও তো রুমে টিভি দেখছে।
আমি মিশুর মাথায় একটা মৃদু চাপড় দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। এই মায়া! মেয়েটার সাহস তো কম নয়!
মায়া পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। আমার বাবা আর ওর বাবা একই অফিসে চাকরি করেন। সেখান থেকেই দুই পরিবারে সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে। বাবা তো মায়াকে দেখে একেবারে বউমা হিসেবেই পছন্দ করে ফেলেছে!
কিন্তু আমি? আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না প্রেম-বিয়ে নিয়ে ভাবার। মেয়েদের প্যানপ্যানানি, ন্যাকামি আমি সহ্য করতে পারি না। আর মায়া? সে তো একেবারে দস্যু রানি!
প্রথম থেকেই সে আমাকে নানাভাবে জ্বালিয়ে আসছে। আমার ফোন নম্বর জোগাড় করে ফালতু কল, রাস্তা ঘাটে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা, কখনো মুচকি হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় কাবু করার কৌশল।
এইবার তো সে এক কাঠি সরেস! প্রাইভেট টিউটরের অভাব দেখিয়ে আমাকে জোর করে মিশুর শিক্ষক বানিয়ে ছেড়েছে!
আমি মায়ার রুমের দিকে এগোলাম।
– আরে স্যার, কখন এলেন?
মায়া টিভির দিকে তাকিয়ে বলল।
– এই তো মাত্রই। কী করছো?
– টম এন্ড জেরি দেখছি, দেখবেন?
– না, তুমি দেখো।
মায়া প্যাকেট থেকে আচারের কাচের বয়াম বের করল।
– স্যার, আম্মুর হাতের আচার খাবেন?
– না, তুমি খাও।
মায়া আচারের টুকরো মুখে পুরে বলল,
– স্যার, এখানে বসুন।
– কোথায়?
– আমার পাশে।
আমি চোখ কুঁচকে বললাম, “চুপ করো”।
মায়া থেমে গেল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
– স্যার, আপনি কেন আমাকে পাত্তা দেন না?
আমি হতচকিত!
– মানে?
– মানে, আমি তো আপনাকে সবসময় খোঁজ করি, কিন্তু আপনি আমার দিকে তাকানও না!
আমি একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম।
– এসব কী বলছো? যাও, এক গ্লাস পানি নিয়ে আসো।
মায়া কিছু বলল না, উঠে গেল রান্নাঘরের দিকে।
মিশুর জন্মদিনের দিন আমি মায়াকে দেখলাম নতুন শাড়িতে। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। মেয়েটাকে অন্যরকম লাগছে! কিন্তু আজ মিশু একেবারে চুপচাপ, আর মায়া? সে যেন আমায় এড়িয়ে চলছে!
আমি বুঝতে পারলাম, কিছু একটা হয়েছে।
মিশুর কাছে জানতে চাইলাম,
– কী হয়েছে তোমার আপুর?
মিশু মাথা নিচু করে বলল,
– আপু বলেছে আপনাকে যেন আর দুলাভাই না ডাকি।
আমি একটু ধাক্কা খেলাম।
মায়ার রুমের দরজা বন্ধ। আমি ভেতরে ঢুকে বললাম,
– তুমি ঠিক আছো?
– হুম, কেন?
– নাহ, আগের মতো আর কথা বলো না কেন?
মায়া চোখের কোণে জল সামলানোর চেষ্টা করল।
– আপনার কী যায় আসে?
আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
– মায়া, প্লিজ বলো, কী হয়েছে?
– কিছু হয়নি! আপনি আমার সাথে কেন এত কঠোর? আমি তো শুধু আপনাকে ভালোবেসেছি…
আমি হতবাক! মেয়েটা এই প্রথমবার ভালোবাসার কথা বলল!
আমার গলা শুকিয়ে গেল।
– মায়া…
– প্লিজ, কিছু বলবেন না…
তারপর সে হন হন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল, আমাকে একা ফেলে রেখে।
সেই রাতের পর থেকে আমি বদলে গেলাম। আমি বুঝতে পারলাম, আমি কখন যে মায়ার প্রেমে পড়ে গেছি, নিজেও জানি না।
মায়া আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে, আর আমি? আমি শুধু পালিয়ে বেড়াই!
কিন্তু আর না।
এবার পালানোর পালা শেষ।
আমি মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
– শুনো, আমি তোমাকে বিয়ে করব।
মায়া বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।
তার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
সেই হাসিটা, যেটা আমার ভীষণ প্রিয়, আবারও ফিরে এল!
সেদিন রাতে মায়ার হঠাৎ বদলে যাওয়া আচরণ আমাকে কেমন জানি এলোমেলো করে দিল। মিশুর জন্মদিনে ওর চোখের কাজল, শাড়ির ভাঁজ, ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা সেই মিষ্টি হাসি—সবই ছিল, শুধু আমার দিকে তাকানোর ইচ্ছেটা ছিল না।
মায়া কেন এমন করছে? এই প্রশ্ন মাথার মধ্যে একবার গেঁথে গেলে আর সহজে বের হওয়ার নয়। আমি যতই ভাবতে চেষ্টা করি, কোনো উত্তর খুঁজে পাই না। রাতে ঘুম আসছিল না। ফোন হাতে নিয়ে মায়ার নম্বরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ, কল দেওয়ার সাহস হলো না। মনে হলো, মায়া যদি বিরক্ত হয়? যদি রাগ করে? আবার মনে হলো, ও যদি আমার ফোনের অপেক্ষায় থাকে?
অনেকক্ষণ দ্বিধার পর অবশেষে একটা মেসেজ পাঠালাম—
“ঘুমিয়েছ?”
দেখলাম, টিক টিক করে সীন হয়ে গেল, কিন্তু উত্তর এল না। মায়া অনলাইনে আছে, কিন্তু রিপ্লাই দিচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর আর থাকতে পারলাম না, সরাসরি কল দিলাম। রিং হচ্ছে, কিন্তু মায়া ধরছে না। বুকের মধ্যে ধকধক শব্দ যেন আরও বেড়ে গেল।
দ্বিতীয়বার কল দেওয়ার আগেই দেখি ওর রিপ্লাই এসেছে—
“হুম, ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।”
আমি জানতাম, মায়া মিথ্যে বলছে। আমার কল না ধরার জন্য এটা একটা অজুহাত মাত্র। তবুও কিছু বললাম না। শুধু লিখলাম—
“ভালো আছ?”
মায়া এবার একটু দেরি করে লিখল—
“হুম, ভালো।”
তিন অক্ষরের এই উত্তর যেন হাজারটা প্রশ্নের সৃষ্টি করল আমার মনে। আগে মায়ার কথার ফুলঝুরি বন্ধ হতো না, আর এখন কথাগুলো কেমন যেন শুকনো হয়ে গেছে।
আমি কিছুক্ষণ পর আবার লিখলাম—
“তুমি কি আমার উপর রাগ করেছ?”
এবারও বেশ কিছুক্ষণ পর উত্তর এল—
“না।”
এই ‘না’-এর মধ্যে কেমন একটা ‘হ্যাঁ’ লুকিয়ে ছিল, সেটা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম।
আমি আর কিছু না বলে শুধু লিখলাম—
“কাল দেখা হবে?”
কিছুক্ষণ টাইপিং দেখা গেল, তারপর মেসেজ এল—
“না, কাল অনেক ব্যস্ত থাকব।”

এটাই ছিল মায়ার শেষ মেসেজ। আমি আর জোর করিনি।
পরের দিন বিকেলে পড়াতে গিয়ে দেখি, মিশু যথারীতি টেবিলে বসে পড়ছে, কিন্তু মায়ার কোনো খবর নেই। সারাক্ষণ যে মেয়েটা সামনে ঘুরঘুর করত, নানা ফাজলামি করত, সে আজ কোথাও নেই!
আমি মিশুকে জিজ্ঞাসা করলাম—
“তোর আপু কোথায়?”
মিশু কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল—
“আপু বাইরে গেছে, একটু পর আসবে।”
আমি বুঝলাম, কিছু একটা ঘটেছে, কিন্তু মিশু বলবে না।
প্রায় আধা ঘণ্টা পড়ানোর পর দরজার খটখট শব্দ পেলাম। মাথা তুলে দেখি, মায়া এসেছে। চোখ-মুখ শুকনো, ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমাকে দেখে এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল, তারপর ধরা ধরা কণ্ঠে বলল—
“এই যে, এসেছ? ভালো আছ?”
আমি মাথা নাড়লাম—
“তুমি কোথায় ছিলে?”
মায়া কোনো উত্তর দিল না, শুধু ভেতরে গিয়ে বসে পড়ল। আমি বুঝতে পারছিলাম, ওর চোখ দুটো লালচে, যেন কেঁদে এসেছে।
আর থাকতে পারলাম না, ধীর গলায় জিজ্ঞেস করলাম—
“মায়া, আমার সঙ্গে কথা বলবে?”
মায়া ফিসফিস করে বলল—
“তুমি কি খুব ভালোবাসো আমাকে?”
এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এতদিন ধরে মায়ার নানা ফাজলামির মধ্যেও ওর চোখে একটা ভালোবাসা দেখেছি, কিন্তু ও কখনো এমন সরাসরি কিছু বলেনি।
আমি গভীরভাবে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম—
“হ্যাঁ, বাসি। খুব বাসি। এটা কি নতুন করে জিজ্ঞেস করার বিষয়?”
মায়া চোখ নামিয়ে ফেলল। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল—
“তাহলে একটা কথা বলব?”
আমি শ্বাস চেপে বললাম—
“বলো।”
মায়া একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—
“আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।”
শুনে মনে হলো, মাথার ভেতর একটা বিস্ফোরণ হলো। শরীরের ভেতর দিয়ে যেন একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল।
“কি?”
মায়া চোখ নামিয়ে ফেলল, তারপর নিচু গলায় বলল—
“হ্যাঁ, আব্বু ঠিক করেছেন। সামনে মাসে এনগেজমেন্ট।”
আমি যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না।
“তুমি রাজি?”
মায়া চোখে পানি এনে বলল—
“আমি জানি না, শুভ্র! আমি জানি না। শুধু জানি, আব্বুর কথার বাইরে যাওয়ার সাহস আমার নেই।”
আমার মাথা ঘুরছিল।
এই মেয়ে, যে সারা দিন আমাকে পাগল করত, যে সারা দিন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত, সে আজ অন্য কারো হয়ে যাবে?
আমি কেমন জানি ফিসফিস করে বললাম—
“তাহলে আমি চলে যাচ্ছি, মায়া।”
মায়া এবার পুরোপুরি ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল—
“শুভ্র, প্লিজ! আমাকে ভুল বুঝো না। আমি তো কখনো চাইনি এটা হোক!”
আমি কিছু বললাম না। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ধীর পায়ে দরজার দিকে এগোলাম।
মায়া তখনও ফিসফিস করে বলছে—
“শুভ্র, কিছু বলবে না?”
আমি থমকে দাঁড়ালাম, এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করলাম। তারপর শুধু বললাম—
“ভালো থেকো, মায়া।”
সেদিন দরজা খুলে বেরিয়ে আসার সময় মনে হলো, আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গেছে।
(চলবে…)