ঘুম থেকে উঠতেই কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম।
কার কান্না? সকালবেলা এমন কান্নার আওয়াজ কেন?
কৌতূহল চেপে রাখতে পারলাম না।
আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামলাম। কান পেতে শব্দটা অনুসরণ করতেই মনে হলো, ড্রইং রুম থেকেই আসছে।
আমার বুক ধক করে উঠল।
ড্রইং রুমে কান্নার শব্দ মানে কি?
কোন মেয়ে এসে আমার নামে বিচার দিচ্ছে না তো?
ভাবতেই শরীর শিরশির করে উঠল।
হালকা করে পর্দাটা সরিয়ে উঁকি দিলাম।
এমা! যা ভেবেছিলাম, তার কিছুই হচ্ছে না।
আমার পুরো পরিবার ড্রইং রুমে বসে আছে।
আর টিভিতে একটা ইমোশনাল দৃশ্য চলছে।
এজন্য সবাই কাঁদছে!
আমার এই পরিবার পৃথিবীর সবচেয়ে আবেগী পরিবার!
আস্তে করে পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ইমোশনাল দৃশ্য শেষ, এবার রোমান্টিক দৃশ্য চলছে।
আমি নিজের ভেতরেও এক ধরনের রোমান্টিক অনুভূতি টের পেলাম।
কিন্তু হঠাৎ চোখ ঘুরিয়ে দেখি—পরিবারে সদস্য সংখ্যা তো ১০ জন!
কিন্তু এখন ১১ জন লাগছে!
ব্যাপার কী?
রাতারাতি কারও বাচ্চা হয়ে গেল নাকি?
মাথা চুলকাতে চুলকাতে রুমে চলে গেলাম।
আমাকে কেউ খেয়ালই করল না!
রুমে বসে চিন্তা করছি—এগারো নম্বর সদস্য কে?
হঠাৎ মনে হলো, খুব চেনা কাউকে দেখেছি!
কিন্তু কে?
মেমোরিটা রিস্টোর দিলাম।
আবার সবার মুখ মনে করার চেষ্টা করলাম।
একটা মুখ আলাদা ছিল!
ওহহহ গড!!
মেঘা!
মেঘা আমার বাসায় কীভাবে?
খাইছে রে!
আজ আমার শ্রাদ্ধ এখানেই হবে!
প্রিয়াস, সময় থাকতে দৌড় দে!
কোনোরকমে কাপড় পরে দৌড় দিতে গিয়েই পিছলে পড়লাম।
সরাসরি গিয়ে পড়লাম…
মেঘার কোলে!
চোখ খুলে দেখি, মেঘা হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
আমি মনে মনে ভাবছি—
“যে কলার খোসা ফেলেছে, তাকে খুঁজে বের করব!
এটার জন্যই আজ আমি এত বিপদে!”
এখন বাঁচার একটাই উপায়… অভিনয়!
আমি কাতর স্বরে বললাম—
“ওমাগ! কী ব্যথা গো! আমি শেষ!”
মা-বাবা সবাই দৌড়ে এলেন।
পরিবারের একমাত্র ছেলে বলে কথা! আদর তো একটু বেশিই পাব।
- “কী হইছে বাবা তোর?” মা জিজ্ঞেস করলেন।
- “কোথায় ব্যথা পেয়েছিস?” বাবা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন।
- “এই যে, পায়ে আর কোমরে…” আমি করুণ গলায় বললাম।
স্নিগ্ধা, আমার কাজিন, সাথে সাথেই বলে উঠল—
“কাকিমা, সব ঢং! কোনো ব্যথা পায় নাই!”
এই মেয়ে এমন হিটলার কেন?
বাবাও বললেন—
“বুঝছি! এমন উল্লুকের মতো চললে এমনই হবে!”
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম—
“মা! আমি উল্লুক?”
মা বিরক্ত হয়ে বললেন—
“হইছে, ভাব নিস না! তোকে আমি চিনি! সুন্দর করে উঠে রুমে যা!”
আমি মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম—
“মা, ব্যথা পাইছি!”
স্নিগ্ধা তখন ফিক করে হেসে বলল—
“ঐ, তুই উঠ আর না উঠ, আমার বান্ধবীর কোল থেকে উঠ!”
আমি ধাক্কা খেলাম!
স্নিগ্ধার বান্ধবী?!
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম—
“তোরও বান্ধবী আছে?”
স্নিগ্ধা চোখ উল্টে বলল—
“এটা কেমন প্রশ্ন?”
আমি বললাম—
“না মানে, তুই এত গুন্ডা টাইপের! তোকে দেখে তো বান্ধবী হওয়ার কথা না!”
স্নিগ্ধা মুচকি হেসে বলল—
“যার কোলে শুয়ে আছিস, সে আমার থেকেও বড় গুন্ডা!”
আমি হতভম্ব হয়ে মেঘার দিকে তাকালাম।
মেঘা তখন ঠোঁট কামড়ে হাসছে।
আমার মনে হলো, “প্রিয়াস, ভাগ! নাহলে আজ তোর শ্রাদ্ধ!”
কিছুক্ষণ পর রুমে গিয়ে বসে রইলাম।
বাইরে যেতে ভয় লাগছে।
ড্রইং রুমে কেউ নেই! সবাই গেল কোথায়?
স্নিগ্ধার রুমে গেলে কেমন হয়?
মেঘাও নিশ্চয়ই ওখানে আছে!
স্নিগ্ধার রুমের দরজায় নক করলাম।
স্নিগ্ধা দরজা খুলল।
আমি উঁকি দিয়ে মেঘাকে খুঁজলাম।
স্নিগ্ধা বুঝে ফেলল!
“ঐ! কী হইছে বল!”
আমি ব্যাকুল গলায় বললাম—
“না মানে, তোর রুমটা অনেকদিন দেখি না, তাই আসলাম!”
স্নিগ্ধা বিরক্ত হয়ে বলল—
“আজ আসতে হবে না!”
আমি তো কিছুতেই ছাড়ব না!
“আজ তোর রুম দেখতে ইচ্ছা করছে!”
স্নিগ্ধা জোরে দরজা বন্ধ করতে চাইল, কিন্তু আমি ঢুকে পড়লাম।
অতঃপর আমার চোখ পড়ল মেঘার দিকে!
মেঘা ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকাল।
আমি একটু মুচকি হেসে বললাম—
“আপনি তো খুব রাগি! আমার উপরে পড়ে গিয়েছিলাম, মাইন্ড করেননি তো?”
মেঘা ঠান্ডা স্বরে বলল—
“না ভাইয়া, মাইন্ড করি নাই!”
আমার মাথার ওপর বাজ পড়ল!
ভাইয়া??
আমি চমকে গিয়ে বললাম—
“আমি ভাইয়া?”
স্নিগ্ধা ফিক করে হেসে বলল—
“হ্যাঁ, তুই আমার ভাই! মানে তোর জন্য মেঘাও ভাইয়া!”
আমি তখন পাথরের মতো বসে পড়লাম।
কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দেখি, মেঘা দাঁড়িয়ে!
তার চোখ দুটো অগ্নিদগ্ধ!
হঠাৎ সে এগিয়ে এসে আমার গলা টিপে ধরল!
আমি ভয়ে চিৎকার করলাম—
“শেষ ইচ্ছাটা বলতে দাও!”
মেঘা চোখ সরু করে বলল—
“তোর শেষ ইচ্ছার খাতা ছিঁড়ে ফেলব!”
আমি বললাম—
“ওহহহ! তাহলে ফায়ার সার্ভিস ডাকি?”
মেঘা রাগে কাঁপতে লাগল!
আমি তখন কাতর স্বরে বললাম—
“জানু, চেত কেন?”
মেঘা এবার একটু শান্ত হলো।
তার চোখে একটু ভালোবাসা খেলে গেল।
“তোমার পরিবার তোমাকে এত কম দাম দেয় কেন?”
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম—
“ওই যে স্নিগ্ধা! ওকে আমি একদিন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম! আর এখন আমাকেই বকা দেয়!”
হঠাৎ দেখি, স্নিগ্ধা দরজায় দাঁড়িয়ে!
আমি চিৎকার করে বললাম—
“মেঘা, দরজা লক করনি?”
মেঘা হেসে বলল—
“শুধু মিলিয়ে রেখেছিলাম!”
আমার মাথায় হাত!
আজ আমার শ্রাদ্ধ নিশ্চিত!
কিন্তু, কিছুক্ষণ পরই শুনলাম—
বাবা বলছেন—
“বিয়ে হবে দশদিন পর!”
আমি মেঘার দিকে তাকালাম।
সে লাজুক হাসল।
এবার আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না!
“ইয়াহু!!!” 😍
রুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলল। আমি আতঙ্কে গুটিয়ে গেলাম। কেউ কি জানে না, আমি আজকে আর কোনো ঝামেলা নিতে পারবো না? চোখ বড় করে তাকিয়ে দেখি— হ্যাঁ, এ তো মেঘা!
- “তোর সর্বনাশ হবে আজকে, প্রিয়াস!” – মেঘা দাঁতে দাঁত চেপে বলল।
- “আরে বউ, এমন গম্ভীর কেন?” – আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, যাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।
- “বউ?” – মেঘা চোখ ট্যারা করে তাকাল, যেন আমায় খেয়ে ফেলবে।
- “হুম! দশ দিন পর তো বিয়েই হয়ে যাচ্ছে! একটু আগেই তো তুই নিজে বললি সবার সামনে, আমাদের বিয়ে হতে হবে! তাই এখন থেকেই তোর সাথে রোমান্টিক হওয়া দরকার, কি বলিস?”
আমি হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু মেঘা আমার দিকে ধেয়ে এল। আমি চোখ বন্ধ করলাম, ভাবলাম— এই বুঝি শেষ! কিন্তু…
- “তুই আমাকে ভালোবাসিস না?” – হঠাৎ করেই মেঘার গলার স্বর বদলে গেল।
আমি ধীরে ধীরে চোখ খুললাম। এই প্রথমবার মেঘাকে এত নরম গলায় কথা বলতে শুনলাম। ওর চোখ দুটো কেমন যেন গলে যাওয়া চকোলেটের মতো দেখাচ্ছে। আমি কথা বলতে গিয়েও পারলাম না। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ শব্দ হচ্ছে।
- “তুই আমাকে কি সত্যি সত্যি বিয়ে করতে চাস, নাকি সব মজা করছিলি?”
মেঘার চোখে অদ্ভুত এক মায়া। আমি তড়িঘড়ি করে উঠে বসলাম। মাথার সব দুষ্টুমি এক মুহূর্তে উধাও!
- “মেঘা, আমি তোর সাথে মজা করিনি। আমি তোকে সত্যি সত্যি ভালোবাসি। কিন্তু তুই তো আমাকে ভাইয়া বলে ডাকলি…”
আমার কণ্ঠে অভিমান ফুটে উঠল।
- “ওহহ, তাই তো!” – মেঘা ঠোঁট কামড়ে ধরল, যেন নিজের ভুলটা বুঝেছে।
- “তো এখন কি করবি?” – আমি কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
- “এই করব!” – বলে মেঘা আমার গালে একটা খোঁচা দিলো।
- “ওমাগ! এটা কি হলো?” – আমি চোখ কপালে তুলে বললাম।
- “তোর শাস্তি! আরেকবার আমাকে ‘আপু’ বলে ডাকলে, কান মলে লাল করে দেব!”
আমি হেসে ফেললাম। মেঘাও মিষ্টি করে হাসল। মুহূর্তটা স্বপ্নের মতো লাগছিল।
ঠিক তখনই…
“এই প্রিয়াস! তোর টাকা নেওয়ার কাহিনি শুনে আমরা সবাই মিটিং ডেকেছি! বাইরে আয়!”
স্নিগ্ধার গলা শুনে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল।
- “এরা তো এখন আমার কেস খাবে!” – আমি ফিসফিস করে বললাম।
- “বউ তো পাশে আছে, ভয় কিসের?” – মেঘা মুচকি হাসল।
- “সত্যি তো! এখন তো আমার শক্তির উৎস তুই!” – আমি চোখ ছোট করে বললাম।
মেঘা আমার হাত টেনে ধরল।
- “চল, একসাথে লড়াই করি!”
আমাদের দুজনের হাত শক্ত করে ধরা। মনে হচ্ছিল, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের প্রেমের গল্পটা এখনো শুরুই হয়নি, কিন্তু মনে হচ্ছিল— এটাই হবে এক চিরন্তন ভালোবাসার গল্পের শুরু…
(চলবে…) 🔥💖