আমাকেও একটা চকলেট দিন।”
মেয়েটা চোখ বড় বড় করে তাকাল, যেন খুব অবাক হয়েছে। “আপনাকে কেন দিব?”
“তাহলে এদের কেন দিচ্ছেন?” আমি ঠোঁট বাঁকিয়ে বাচ্চাদের দিকে ইঙ্গিত করলাম।
“এরা তো বাবু তাই। আর আপনি তো অনেক বড়…”
আমি হাসলাম। “আমার মা এখনও আমাকে বাবু বলে ডাকে। চকলেট পাওয়ার জন্য এই লাইসেন্সটা কি যথেষ্ট নয়?”
একটু হাসি চাপতে গিয়ে মেয়েটার চোখে একরকম দুষ্টুমির ঝিলিক দেখলাম। তারপর সে একটানা তাকিয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা, এই নিন চকলেট।”
চকলেটটা হাতে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “আপনি এত কিপ্টে কেন?”
“কিপ্টামি করলাম কোথায়?”
“একটা চাইলাম বলে একটাই দিলেন।”
সে আবার হেসে বলল, “আপনিতো বাবু! আর বাবুরা বেশি চকলেট খেলে দাঁতে পোকা ধরে। হি হি হি…”
দিন দিন অলসের মতো হয়ে যাচ্ছি। কোনো দরকার ছাড়া বাইরে বের হতেও ইচ্ছে করে না। সারাদিন ঘরে থাকি বলে মা আজ এতগুলো বকা দিয়েছে! তাই বিকেলে একটু হাঁটতে বের হলাম।
স্কুল মাঠের পাশে গিয়ে দেখি, কালো রঙের ড্রেস পরা একটা মেয়ে কিছু বাচ্চাদের চকলেট দিচ্ছে। আমার প্রিয় রঙ কালো, আর মা বলে ফর্সা মানুষের কালো পোশাক খুব ভালো লাগে। সত্যিই, মেয়েটাকে অপূর্ব লাগছে। যেন কোনো গল্পের রাজকন্যা।
বাচ্চারা চকলেট পেয়ে যেমন খুশি, তার থেকেও বেশি উচ্ছ্বাস মেয়েটার চোখেমুখে। আমি একটু ফাজিল স্বভাবের, তাই দুষ্টুমি করার জন্য এগিয়ে গিয়ে চকলেট চাইলাম। তারপরই আমাদের কথোপকথন হলো।
মেয়েটা চলে যাওয়ার পর বাচ্চাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, সে প্রতি শুক্রবার এখানে আসে চকলেট দিতে। নাম জানতে চাইলে ওরা বলল, “আপুনি”। বুঝলাম, এরা আসলে ওর নাম জানে না।
আজ শুক্রবার। আমি আবারও গেলাম, তবে চকলেট নেওয়ার জন্য নয়, মেয়েটাকে দেখার জন্য।
“আমার চকলেটটা দিন।”
মেয়েটা একটু অবাক হয়ে বলল, “আপনি আবার এসেছেন?”
“কেন, আমার আসা নিষেধ নাকি? কই, চকলেটটা দিন।”
সে আবারও হাসল, “বললাম না, বেশি চকলেট খেলে দাঁতে পোকা হয়।”
আমি একটুও ছাড় দিলাম না, “তাহলে এদের দিচ্ছেন কেন? এদের দাঁতে বুঝি পোকা হবে না?”
“ওদের তো দাঁতই নেই, পোকা হবে কীভাবে? হি হি হি…”
আমি চুপ করে রইলাম। মেয়েটা আসলেই আমার থেকেও বেশি ফাজিল! একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, “থাক, মন খারাপ করবেন না। এই নিন চকলেট।”
চকলেট হাতে নিয়ে বললাম, “থ্যাংক ইউ আপুনি।”
সে চোখ কুঁচকে বলল, “এই যে মিস্টার, আমি আপনার ছোট। আর আমি আপনার আপুনি নই!”
আমি একটু মজা নিলাম, “ওহ, তা আপনার নাম কী?”
“আপনাকে কেন বলব?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম, “থাক, বলার দরকার নেই। আপনার নাম তো জরিনা বেগম। দেখতেও তো জরিনার মতো।”
সে চোখ বড় করে তাকাল, “আমার নাম ঈশানা।”
আমি মুখ টিপে বললাম, “কি নাম রে বাবা! নিশানা?”
সে ঠোঁট উল্টে বলল, “ওই হ্যালো! নিশানা নয়, ঈশানা! ঈশানা হক।”
আমি মনে মনে হাসলাম। বুদ্ধি করে নামটা জেনে ফেলেছি!
বন্ধুদের কাছ থেকে খোঁজ নিয়ে জানলাম, মেয়েটা বরিশাল বি.এম. কলেজে ম্যানেজমেন্ট পড়ছে। এরপর থেকেই ঈশানাকে ফলো করা শুরু করলাম। ওর বাসা থেকে শুরু করে কলেজ, কোচিং—সব জায়গায় আমার উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক!
ওর কলেজ ছুটির সময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাক দিল, “এই যে মিস্টার ফলোয়ার!”
পিছনে ফিরে দেখি, ঈশানা দাঁড়িয়ে আছে, চোখে হাসির দুষ্টু ঝিলিক।
“কি খুব অবাক হচ্ছেন? আমি অনেকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি, আপনি আমাকে ফলো করেন। আজ আপনাকে ধরার জন্য কলেজ থেকে আগে বের হয়েছি!” সে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়াল। “ব্যাপার কী, হুম?”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “না মানে, ইয়ে… চকলেট নিতে এসেছি।”
সে ভ্রু কুঁচকে বলল, “মানে? আমি কি চকলেট মন্ত্রী?”
আমি মুচকি হাসলাম, “না মানে, আপনার দেওয়া চকলেটগুলো খুব টেস্টি। বাজারে কোথাও পাইনি তো…”
সে এক দৃষ্টি আমার দিকে তাকাল। “আচ্ছা, তাই? তা আমার বাসার সামনে ঘোরাঘুরি করেন কেন?”
আমি অবাক! ওকে তো কখনো বাসার সামনে দেখি নাই! তাহলে জানল কীভাবে?
সে হাসল, “বাইরে থেকে আমাকে দেখতে না পেলেও, থাই গ্লাসের ভেতর থেকে আমি ঠিক আপনাকে দেখতে পাই।”
আমি চুপ করে রইলাম।
“আপনার মোবাইল দিন।”
বলতে দেরি, দিতে দেরি হয়নি।
সে স্ক্রিনে তাকিয়ে বলল, “এটা লক করা। পাসওয়ার্ড বলুন।”
আমি একটু লজ্জা পেয়ে বললাম, “N I S A N A।”
সে মুচকি হাসল, “এটা আমার নাম্বার। যদি কখনো চকলেট দরকার হয়, কল দিবেন। কিন্তু বাসা, কলেজে ঘোরাঘুরি করবেন না। এটা আমার পছন্দ নয়।”
বলেই সে রিকশায় উঠে চলে গেল। আমি মোবাইল বের করে নাম্বারে কল দিলাম। স্ক্রিনে নাম দেখাল—’চকলেট’।
ঈশানা ফোন ধরল, “হ্যালো?”
আমি বললাম, “এটা কি chokletisana?”
ওর হাসির শব্দ শোনা গেল। “জি বলছি, বলুন! আপনার কি ধরনের চকলেট লাগবে?”
আমি বললাম, “লাভ চকলেট লাগবে।”
ঈশানা একটু থামল, তারপর বলল, “এটার স্টক সীমিত। মাত্র একটা আছে।”
আমি গভীর গলায় বললাম, “আমার ঐ একটা হলেই যথেষ্ট। দেওয়া যাবে কি?”
সে একটু দুষ্টু স্বরে বলল, “যত্ন করে রাখতে পারবেন তো?”
আমি মুচকি হাসলাম, “আমার কাছে একটা আছে। আপনারটা আর আমারটা খুব যত্ন করে রাখব।”
ঈশানা বলল, “হুম, মনে থাকে যেন!”
আমি হাসলাম, “নিশানা নামটা যেহেতু আপনাকেই দিয়েছি, তাই আমার চোখের নিশানাও সবসময় আপনাকে খুঁজবে…”
ঈশানা হালকা হাসল, “হুম, মনে থাকে যেন…”