রিমি বাবার বাড়িতে এসেছে, কিন্তু আনন্দের বদলে একটা চাপা কষ্ট বুকের মাঝে দোলা দিচ্ছে। বিয়ের পর এটা তার তৃতীয়বার আসা, অথচ প্রতিবারই যেন একটা অদৃশ্য দেয়াল টের পায় সে—নিজের আপন বাড়িতেই যেন পর হয়ে গেছে!
সকালে সারোয়ার অফিসে যাবার আগে তাকে এখানে রেখে গেছে, বাবার অনুরোধে। সারোয়ার কিছুটা মন খারাপ করেই বলেছিল,
“সন্ধ্যায় আসব তোমাকে নিতে, অপেক্ষা কোরো।”
তার কথাগুলোই যেন সারাদিন রিমির কানেই বাজছিল।
নাস্তার টেবিলে বসেই তার বড় আপু গর্বভরে বলল,
“এইবারের ঈদে দুলাভাইয়ের সাথে ইন্ডিয়া যাচ্ছি শপিং করতে!”
মেজ আপু সাথে সাথে যোগ করল,
“আমরাও যাব, বলো কবে যাচ্ছো!”
এরপর বড় আপু রিমির দিকে তাকিয়ে একটু কটাক্ষের সুরে বলল,
“রিমি, সারোয়ারকে বলো, কোথাও থেকে টাকা ম্যানেজ করতে পারলে তোমরাও যাবে!”
কথাটা শুনে রিমির বুকের মধ্যে একটুখানি ব্যথা দলা পাকিয়ে উঠল। যেন সারোয়ারের প্রতি অবহেলাটা প্রকাশ্যে চলে এসেছে!
সে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। মা একবার বলেছিলেন, “শান্ত থাকলে মান-সম্মান থাকে”, কিন্তু এই অসম্মানের কি জবাব নেই?
দুপুরের পর মা তিন মেয়েকে ডেকে বসলেন। রিমি বুঝতে পারল, আলোচনা এবারও সারোয়ারকে ঘিরেই হবে।
“তোর শ্বশুরবাড়ির মানুষ কেমন?” মা জিজ্ঞেস করলেন।
“কেমন আবার? ভালো।”
“হলুদের দিন তোর শাশুড়ি যে ঝগড়া করল তোর ফুপির সাথে!”
রিমির রাগ ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছিল। হলুদের দিন আসল দোষ তো ফুপিরই ছিল, মা জানেন সেটা! তবু কেন শুধু তার শাশুড়িকে খারাপ দেখানো হয়?
বড় আপু কটাক্ষের হাসি দিয়ে বলল,
“আহা, বড়লোকের বউ তো! কি আর করবে!”
রিমি এবার আর থাকতে পারল না। উঠে গিয়ে বলল,
“আমি বাবার সাথে একটু কথা বলে আসছি!”
একলা ঘরে বসে কান্না চেপে ফোনটা কানে দিল রিমি।
“কি করছো?”
“তোমাকে মিস করছি!”
“থাক, আর বানিয়ে বলতে হবে না! মিস করলে ফোন দিতে পারতে!”
সারোয়ার হাসল, “ভাবলাম, তুমি ব্যস্ত থাকবে, বিরক্ত করিনি!”
রিমির অভিমান কিছুটা কমলেও মুখে বলল,
“আজ রাতে এখানেই খাবে, বুঝেছো?”
সারোয়ার একটু চুপ থেকে বলল,
“খাবো কিভাবে? তোমার বাবা তো আমাকে দাওয়াতই দেননি।”
কথাটা শুনে রিমি স্তব্ধ হয়ে গেল। সত্যিই তো! তার বাবা সারোয়ারের কথা একবারও জিজ্ঞেস করেননি, অথচ দুই বোনের জামাইকে নিজে থেকে ফোন করে দাওয়াত দিয়েছেন!
চোখের কোনে অজান্তেই জল চলে এলো।
সে ধরা গলায় বলল,
“তাহলে ঠিক আছে, তুমি তাড়াতাড়ি এসো, আমি অপেক্ষা করব!”
সারোয়ার হেসে বলল,
“জ্বি ম্যাডাম, চলে আসছি!”
সন্ধ্যায় মা যখন নানা রকম সুস্বাদু খাবার রান্না করছেন, তখন রিমি কাছে গিয়ে বলল,
“মা, আমি রেডি! সারোয়ার আসলেই চলে যাব!”
মা অবাক হয়ে বললেন,
“মানে? রাতে খেয়ে যাবি না?”
রিমি হেসে বলল,
“তোমার দুই জামাই তো আসবে, তাদেরই না হয় খাওয়াও!”
মায়ের মুখটা শক্ত হয়ে গেল,
“সারোয়ার না খেয়ে চলে গেলে, তোর বাবার মানসম্মান থাকবে?”
রিমির ঠোঁটের কোণে বিদ্রূপের হাসি ফুটল,
“তোমরা তো কেউই সারোয়ারকে খেতে বলোনি। বিনা দাওয়াতে আমার স্বামী এখানে খেলে, আমার মানসম্মান থাকবে?”
মা চুপ হয়ে গেলেন। রিমি বুঝতে পারল, এই নীরবতা তার সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ।
রিকশায় বসেই সারোয়ারের হাতটা শক্ত করে ধরল রিমি।
“আমাকে তো আসতেই দিচ্ছিল না মা। বাবা বারবার বলছিলেন, জামাই না খেয়ে চলে যাবে, কেমন কথা! আমি বলেছি, তুমি আমাকে বাইরে খাওয়াবে!”
সারোয়ার মুচকি হেসে বলল,
“খুব ভালো করেছো। আমরা বাইরে থেকেই খেয়ে ফিরব!”
রিমি তার দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার সম্মান, তোমার ভালোবাসা আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি। তোমার হাত ধরে রিকশায় ঘোরা আমার কাছে বিদেশে শপিং করার থেকেও বেশি আনন্দের! শুধু তুমি পাশে থেকো, আমি সব কষ্ট, অপমান, বিদ্রূপ উড়িয়ে দিয়ে তোমার ভালোবাসার সুখেই ভাসব!”
সারোয়ার এক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর ধীরে ধীরে রিমির হাতটা আরও শক্ত করে ধরল।
রাতের বাতাস রিমির চুল এলোমেলো করে দিল, কিন্তু তার চোখে একটাই স্বপ্ন—একটা জীবন, যেখানে শুধু সারোয়ারের ভালোবাসাই যথেষ্ট!
পরের দিন সকালবেলা, রিমি ঘুম থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়াল। বাইরে মিষ্টি রোদ, গলির ছোট্ট দোকান থেকে ভাপা পিঠার গন্ধ আসছে, পাশের বাসার ছেলেটা ক্রিকেট খেলছে—সব কিছুই আগের মতো, অথচ তার মনে একটা অজানা প্রশান্তি।
সারোয়ারের পাশে বসে থাকা, তার হাত ধরে থাকা, তার ভালোবাসার উষ্ণতা যেন সব কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে।
সারোয়ার তখনও ঘুমাচ্ছে। তার মুখটা এত শান্ত লাগছে, যেন কোনো দুশ্চিন্তা নেই!
রিমি ধীরে ধীরে তার কপালের ওপর চুল সরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“তুমি আছো, এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বড় পাওয়া!”
সারোয়ার চোখ খুলে তাকাল, হাসল, আর ঘুমজড়িত কণ্ঠে বলল,
“তুমি আমার ঘুমের মধ্যেও কথা বলো, আমি কিন্তু শুনতে পাই!”
রিমি হেসে বলল, “ভালোই তো! তাহলে আমার ভালোবাসার কথা সবসময় শুনতে পাবে!”
এমন সুন্দর মুহূর্তের মাঝেই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে রিমির মন খারাপ হয়ে গেল।
ফোন ধরতেই বাবা গম্ভীর গলায় বললেন,
“সারোয়ারকে নিয়ে একটু আসবি? কথা আছে!”
রিমি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে গেল। বাবার এমন টোন কখনও ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না।
সারোয়ার বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়েছে। সে রিমির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“যদি তুমি চাও, তাহলে আমরা যাব।”
বিকেলবেলা, রিমি আর সারোয়ার বাবার বাড়ির দিকে রওনা দিল। সারোয়ারের হাতটা শক্ত করে ধরেছিল রিমি, যেন সে বলছে—”আমি তোমার পাশে আছি!”
বাড়িতে পৌঁছানোর পর, বাবা চুপচাপ বসে ছিলেন। মায়ের চোখেমুখে অস্বস্তি, দুই আপুর ঠোঁটে সুকৌশলী হাসি।
বাবা ধীর গলায় বললেন,
“শুনলাম, কাল রাতে খেয়ে যাসনি?”
সারোয়ার মাথা নিচু করে হাসল, “জ্বি, কাজ ছিল, তাই…”
বড় আপু তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
“কাজ ছিল, নাকি মান-অভিমান?”
রিমির ভেতরটা রাগে ফুটতে লাগল। বাবা আজও সারোয়ারের জন্য একটা ভালো কথা বললেন না!
সে এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না, সোজা বলে উঠল,
“কেন? আমার স্বামীর সম্মান কি তোমাদের কাছে এতটাই তুচ্ছ যে দাওয়াত না পেয়েও তাকে এখানে খেতে হবে?”
বাবা এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেলেন। মা একটু অপ্রস্তুত।
মেজ আপু বলল, “তোমার স্বামী কি এতটাই স্পর্শকাতর যে এতটুকু কিছুতেই অভিমান করে?”
রিমির চোখে আগুন জ্বলছিল।
সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
“না, সে স্পর্শকাতর নয়। কিন্তু আমি চাই না, কেউ তাকে ছোট মনে করুক। তোমাদের কাছে হয়তো টাকার দাম বেশি, কিন্তু আমার কাছে ভালোবাসার দাম সবচেয়ে বেশি!”
ঘরটা নীরব হয়ে গেল। বাবা এবার একটু নরম সুরে বললেন,
“আচ্ছা, ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যায় এসো, একসাথে খাব।”
সারোয়ার একটা মৃদু হাসি দিল।
রিমি বুঝল, এই এক কথার মাঝেই অনেক কিছু লুকিয়ে আছে—সমাজের চোখে সম্মানের প্রশ্ন, পারিবারিক প্রতিযোগিতা, ভালোবাসার মূল্য।
ফিরে আসার সময় রিকশায় বসে রিমি সারোয়ারের কাঁধে মাথা রাখল।
“তোমার রাগ কমলো?” সারোয়ার মুচকি হেসে বলল।
রিমি চোখ বন্ধ করে বলল, “তুমি পাশে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে!”
সারোয়ার গভীর মমতায় তার হাত ধরল। রিমি জানত, এই জীবনটা সহজ নয়, সমাজের চোখে সম্মান আদায় করা কঠিন, কিন্তু সারোয়ারের ভালোবাসায় সে সবকিছু জয় করতে পারবে।
রাতের হাওয়ায় চুল উড়ে গেল, রিমির চোখেমুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তি খেলা করছিল। কারণ সে জানে—
“তুমি আছো, এটাই যথেষ্ট!”
(শেষ)