রিমি বাবার বাড়িতে এসেছে, কিন্তু মনটা যেন কোথাও হারিয়ে গেছে। বিয়ের পর এটি তার তৃতীয়বার আসা, কিন্তু আগের মতো আনন্দ অনুভব করতে পারছে না। সারোয়ার সকালে অফিসের আগে তাকে এখানে নামিয়ে গেছে, রাতেই তাকে নিয়ে যাবে।
বাবার বাড়িতে এসেও কেন যেন একটা শূন্যতা কাজ করছে তার ভেতরে। সেই শূন্যতার কারণ সে ভালো করেই জানে— সারোয়ার নেই পাশে। আর তার পরিবারের কেউ-ই কখনো সারোয়ারকে আপন করে নিতে পারেনি।
রিমির বড় দুই বোন ধনী পরিবারের বউ। তাই তাদের কথায়, আচার-আচরণে সবসময় একটা অহংকার ফুটে ওঠে। সারোয়ারকে তারা সুযোগ পেলেই ছোট করে, খোঁচা দিয়ে কথা বলে। যেমন আজ সকালেই বড় আপু বলল—
“এইবার ঈদ শপিং করতে ইন্ডিয়া যাচ্ছি। তোরা কি করবি?”
মেজ আপু সাথে সাথে যোগ দিল—
“তাই না! আমরাও যাবো আপা!”
তারপর বড় আপু মুচকি হেসে বলল—
“রিমি, তোরও তো ইচ্ছে করছে, তাই না? সারোয়ার যদি কোথাও থেকে টাকা ম্যানেজ করতে পারে, তবে তোদেরও নেওয়া যাবে!”
এই কথাটা শুনে রিমির গায়ে আগুন ধরে গেল। কিন্তু কিছু বলার আগেই মা এসে বোনদের থামিয়ে দিলেন।
দুপুরের খাবারের পর মা পাশের চেয়ারে বসে বললেন—
“হ্যাঁ রে রিমি, তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেমন?”
রিমি জানে, মা কিছু একটা বলতে চাইছেন।
“কেমন আবার? তুমি এটা কী ধরনের প্রশ্ন করলে?”
মা একটু হাসলেন।
“মানে, তোকে ঠিকমতো দেখে-শুনে তো, তাই না?”
রিমি এবার চুপ করে গেল। মা ঠিক তখনই হলুদের দিনের প্রসঙ্গ টানলেন।
“ওইদিন তোর শাশুড়ি কেমন ঝগড়া করলো, মনে আছে তো?”
রিমির বড় আপু এবার হাসতে হাসতে বলল—
“আরে মা, সারোয়ারের মা জানেন না আমাদের ফুপি কেমন! উনি তো কত্তো বড়লোকের বউ!”
রিমি আর সহ্য করতে পারল না। সে কিছু না বলে উঠে গেল, চোখের কোণে জল জমছে। অন্য রুমে গিয়ে কান্না চেপে ধরে মোবাইল বের করল। সারোয়ারকে ফোন দিল।
📞 “হ্যালো, কি করছো?”
📞 “তোমাকে মিস করছি,” হাসি দিয়ে বলল সারোয়ার।
📞 “থাক, বানিয়ে বলার দরকার নেই! এতক্ষণে একটা ফোনও দাওনি!” অভিমানী কণ্ঠে বলল রিমি।
📞 “আরে না, সত্যি বলছি! আমি জানতাম তুমি আপুদের সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত, তাই বিরক্ত করিনি।”
📞 “রাতে তুমি আসবে তো? এখানেই খাবে কিন্তু!”
📞 “খাবো কীভাবে? তোমার বাবা তো কিছু বলেননি!”
রিমি থেমে গেল। সত্যিই তো, তার বাবা সারোয়ারকে একবারও খাওয়ার জন্য বলেননি। অথচ তার দুই বোনের জামাইকে দু’বার ফোন দিয়ে দাওয়াত দিয়েছেন।
📞 “আচ্ছা, ঠিক আছে। খেতে হবে না তোমার। তাড়াতাড়ি এসে আমায় নিয়ে যেও।”
📞 “জ্বি ম্যাডাম, আমি আসছি!”
রাতে মা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। সুস্বাদু খাবারের আয়োজন চলছে। রিমি কাছে গিয়ে বলল—
“মা, আমি রেডি। সারোয়ার এলে চলে যাবো।”
মা অবাক হয়ে তাকালেন—
“মানে? খেয়ে যাবি না? এত আয়োজন তবে কার জন্য?”
রিমি মুচকি হেসে বলল—
“তোমার দুই মেয়ের জামাই আসবে তো! তাদেরই না হয় খাইয়ে দিও!”
মা গম্ভীর হয়ে বললেন—
“সারোয়ার আসবে না? ও না খেয়ে গেলে তো মানুষের কাছে মানসম্মান থাকবে না!”
রিমি হাতের চুড়ি নাড়াতে নাড়াতে বলল—
“তোমরা তো কেউ ওকে দাওয়াত দাওনি। বিনা দাওয়াতে আমার স্বামী এখানে খেলে আমার মানসম্মান থাকবে?”
মায়ের মুখ শক্ত হয়ে গেল।
“ঠিক আছে, তুই একাই খেয়ে যা!”
রিমি এবার দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“যে খাবার খাওয়ার ভাগ্য আমার স্বামীর হয়নি, সেটা আমি খেতে পারবো না।”
রিকশায় বসে সারোয়ারের হাত ধরে রিমি বলল—
“তোমাকে দাওয়াত দেয়নি ঠিকই, কিন্তু বাবা বারবার বলছিল, জামাই না খেয়ে গেলে কেমন দেখায়! আমি বলে দিয়েছি, আজ রাতে তুমি আমাকে বাইরে খাওয়াবে! আমি ঠিক করেছি না?”
সারোয়ার একগাল হাসল।
“তুমি একদম ঠিক করেছো। আমরা বাইরে থেকেই খেয়ে যাবো।”
রিমি তার হাতটা শক্ত করে ধরে মনে মনে বলল—
“তোমার ভালোবাসা, তোমার সম্মান আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামি জিনিস। তোমার পাশে থাকাটাই আমার জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া। এই ছোট ছোট সুখই আমার জন্য সবচেয়ে বড় আনন্দ!”
রিকশায় বসে রিমি সারোয়ারের হাত শক্ত করে ধরে আছে, যেন এই স্পর্শের মধ্যে সব অভিমান, কষ্ট মিলিয়ে দিতে চায়। সারোয়ার মুচকি হেসে ওর দিকে তাকাল।
“কি হলো? এত চুপ কেন?”
রিমি মাথা নিচু করে বলল,
“আজও তারা তোমাকে ছোট করতে ছাড়ল না। তোমাকে নিয়ে কত ধরনের কথা বলল। জানো, মা পর্যন্ত তোমার জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করল না। অথচ আপুদের জামাইদের জন্য কত আয়োজন!”
সারোয়ার হাসিমুখেই বলল,
“ওরা ওদের জায়গা থেকে ঠিকই আছে, আর আমি আমার জায়গা থেকে ঠিক। আমি তো তোমাকে পেয়েছি, বাকিদের স্বীকৃতি পাওয়ার দরকার নেই।”
রিমি চোখের জল আটকে রাখার চেষ্টা করল। সারোয়ার কত সহজেই সব কিছু মেনে নেয়! কিন্তু ওর ভালোবাসার মানুষটাকে কেউ যখন সম্মান দেয় না, তখন ওর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে।
রিকশাটা ধীরে ধীরে শহরের ব্যস্ত রাস্তায় এগিয়ে চলল। চারদিকে দোকানের ঝলমলে আলো, মানুষের কোলাহল, রাস্তার ধারে টঙ দোকান থেকে ভেসে আসা চায়ের গন্ধ—সবকিছু কেমন স্বাভাবিক, অথচ রিমির মনে তোলপাড় চলছে।
সারোয়ার হঠাৎ রিকশাওয়ালাকে থামতে বলল।
“এসো, কিছু খেয়ে নিই। তুমি তো সারাদিন ভালো মতো কিছু খাওনি।”
একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁর সামনে দাঁড়িয়ে ওরা ঢুকে গেল। সারোয়ার নিজের মতো করে ওর জন্য খাবার অর্ডার দিল। রিমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল।
“তুমি তো জানো না, আমি কী খেতে চাই!”
সারোয়ার হেসে বলল,
“জানি, তুমি রাগ করে থাকলেও শেষমেশ ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন চিলিই খাবে।”
রিমি একটু অবাক হলো। সারোয়ার এত কিছু খেয়াল করে! কেউ তো ওর এতটা যত্ন নেয় না। খাবার আসতেই সারোয়ার নিজে হাতে রিমির প্লেটে তুলে দিল।
“খাও তো, দেখি তোমার রাগ কমে কিনা!”
রিমি চুপচাপ খেতে শুরু করল। ওর মনের ভেতর যতটা কষ্ট জমে ছিল, সারোয়ারের কথায় সেটা যেন একটু একটু করে গলে যেতে লাগল।
খাওয়া শেষে দুজন পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। রাতের বাতাসটা বেশ ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। সারোয়ারের শার্টের হাতা টেনে ধরল রিমি।
“তুমি আমাকে সত্যিই মিস করেছিলে?”
সারোয়ার এবার থেমে ওর দিকে তাকাল।
“মনে হয় না? তুমি না থাকলে আমি বাসায় ফিরে একদম চুপচাপ হয়ে যাই। তুমি যখন বাবার বাড়ি যাও, তখন আমার ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। তাই আর দেরি করলাম না, তোমাকে আনতে চলে এলাম।”
রিমির বুকটা ভালবাসায় ভরে উঠল। সারোয়ারের চোখে ও সত্যিকারের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। এই মানুষটাকে নিয়ে সবাই যা-ই বলুক, সারোয়ার ওর জীবনের সবচেয়ে দামি সম্পদ।
ও আস্তে করে বলল,
“তোমার হাতটা একটু শক্ত করে ধরতে পারি?”
সারোয়ার হেসে ওর হাতটা শক্ত করে ধরল।
রিমি মনে মনে বলল,
“এই হাতটা আমি কোনোদিন ছাড়ব না।” ❤️