রাত তখন প্রায় ১১টা। চারদিক নিস্তব্ধ। শহরের ব্যস্ততা খানিকটা কমে গেছে। রাস্তার বাতিগুলোর আলো হালকা হলুদ ছায়া ফেলে রেখেছে ফাঁকা রাস্তায়। এমন সময় একটা অটো এসে থামে এক গলির মুখে। অটো থেকে নামে একজন যুবক — কাঁধে ব্যাগ, হাতে মোবাইল, চোখে একরাশ ক্লান্তি। নাম – অভি।
অভি কলকাতায় একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করে। আজ অনেকদিন পর বাড়ি ফিরছে। উত্তরবঙ্গের ছোট্ট একটা শহরে ওর বাড়ি। রাতের শেষ ট্রেনটা মিস হয়ে যাওয়ায়, শহর থেকে একটা অটো নিয়ে পৌঁছেছে এই গলি পর্যন্ত। এখান থেকে মিনিট দশেক হাঁটা পথ।
হাতের ফোনে টর্চ জ্বালিয়ে সে হাঁটা শুরু করে। গলিটার নাম ‘চাঁদনী গলি’। ছোটবেলার কত স্মৃতি জড়িয়ে এই গলিতে। একদিকে পাড়ার মাঠ, অন্যদিকে পুরনো লাইব্রেরি। আর এই পথেই অভির প্রথম প্রেমের গল্পও শুরু হয়েছিল…
তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ত। একদিন স্কুল থেকে ফিরছিল, হঠাৎই প্রথম দেখা — একটা মেয়ের সঙ্গে। পাতলা চশমা, লাল টিপ, হাতে বই — যেন ঠিক যেন উপন্যাসের কোনো চরিত্র। নাম ছিল রীমা।
রীমা ছিল অভির পাশের পাড়ার মেয়ে। বেশ চুপচাপ, ভদ্র, মিষ্টি স্বভাবের। দেখা হওয়া শুরু হল প্রায় প্রতিদিন। শুরু হল কিছু চুপিসারে কথা, মাঝে মাঝে হাসি, আর একদিন এক বিকেলে রীমার হাত ধরে প্রথম প্রেমের স্বীকৃতি।
Bengali Love Story 2025
তারপর?
তারপর হঠাৎই রীমা হারিয়ে যায়। কলেজ পাস করে অভি কলকাতায় চলে যায়, আর রীমা? কোথাও কোনো খবর নেই। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ — কোথাও নেই ওর সন্ধান। সময় গড়ায়, জীবন এগোয়, কিন্তু কোথাও একটা শূন্যতা থেকেই যায় অভির মধ্যে।
আজ এত বছর পর এই চাঁদনী গলিতে ফিরে এসে সেই পুরনো স্মৃতিগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে। হঠাৎই যেন মনে হয়, হয়তো আবার দেখা হবে। কিন্তু বাস্তব তো সিনেমা নয়, তাই না?
ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে ভেসে আসে এক মেয়েলি গলা —
“অভি?”
পিছনে ঘুরতেই স্তব্ধ হয়ে যায় ও। রাস্তার আলোয় সে দেখে — এক চেনা মুখ। সেই চশমা, সেই চোখ, সেই লাজুক হাসি।
“রীমা?” — অবিশ্বাসে অভি কাঁপা গলায় বলে।
রীমা হেসে বলে, “তুমি ঠিক চিনেছো।”
এক মুহূর্তের জন্য সময় থেমে যায়। দুজনেই দাঁড়িয়ে থাকে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অতীত আর বর্তমানের মধ্যে।
অভি কাঁপা কণ্ঠে বলে, “তুমি… এখানে?”
রীমা মাথা নিচু করে বলে, “আজকাল এখানেই থাকি। ফিরে এসেছি মাস তিনেক হল। ভাবিনি, একদিন তুমি এভাবে হঠাৎ…”
অভি থেমে গিয়ে বলে, “তোমার জন্যই তো এই গলিটার কাছে বারবার টান অনুভব করতাম… ভাবতাম, একদিন হয়তো আবার দেখা হবে…”
রীমা চোখ সরিয়ে বলে, “তোমার কোনো খবর পাইনি। একসময় ভেবেছিলাম, তুমি হয়তো ভুলেই গেছো…”
অভি গভীরভাবে চোখে চোখ রাখে রীমার দিকে — “ভুললে কি এতটা রাতেও এই গলিতে ফিরে আসা সম্ভব হতো?”
দুজনের মাঝখানে নীরবতা। যেন রাতের চাঁদ, হালকা বাতাস আর ফাঁকা রাস্তাও থমকে গেছে।
রীমা হালকা করে বলে, “তুমি যদি একটু সময় পাও… আমাদের বাড়িটা পাশেই… এক কাপ চা খাবে?”
অভির মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে — “চা নয়… আজ আবার নতুন করে শুরু হোক আমাদের গল্পটা।”
— (চলবে…)
রাত তখন প্রায় ১১টা ২০। চাঁদের আলো মেঘের ফাঁক দিয়ে এক মুহূর্তে লুকিয়ে পড়ে, আবার ফিরেও আসে। চাঁদনী গলির একতলা বাড়িটার দোতলায় আলো জ্বলছে। জানালার পাশে একটা ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’জন – অভি আর রীমা।
রীমার হাতে দুই কাপ চা, আর অভির চোখে হাজারটা প্রশ্ন।
“তুমি কী করে জানলে আমি আজ এখানে থাকব?” — অভি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
রীমা হালকা হেসে বলল, “জানি না… আসলে জানতাম না। এতদিন পর হঠাৎ তোমার মুখটা দেখেই থমকে গেছিলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না… এতগুলো বছর পর, ঠিক এই জায়গায় আবার দেখা!”
অভি তাকিয়ে থাকে রীমার চোখের দিকে — সেখানে কিছু পুরনো অভিমান, কিছু অনিচ্ছাসত্ত্বেও জমে থাকা ভালোবাসা।
“তুমি হারিয়ে গেলে কেন, রীমা?” — অভির গলা ভারী হয়ে যায়।
রীমা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, “তখন তো আমরা দুজনেই খুব ছোট ছিলাম। পরিবার, সমাজ, পড়াশোনা… সব কিছু নিয়ে এমন এক সময় এল, যখন মনে হয়েছিল… হয়তো আমরা একসঙ্গে থাকতে পারব না। একদিন হঠাৎই বাবা বদলি হয়ে গেলেন শিলিগুড়ি। যাওয়ার সময় তোকে বলতে চেয়েছিলাম… কিন্তু সাহস হয়নি। ভয় পেয়েছিলাম — তুই যদি আটকাস!”
অভি শান্ত গলায় বলে, “তুই জানিস না, সেই দিনটার পর প্রতিদিন আমি গলির কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতাম, শুধু তোকে একবার দেখার জন্য। তুই এলি না… আমি তোকে খুঁজেছিলাম রীমা। পাগলের মতো খুঁজেছিলাম!”
রীমার চোখ চিকচিক করে উঠল। একটুখানি কাঁপা কণ্ঠে বলল, “আমি তোদের বাড়ির ঠিকানা পর্যন্ত লিখে রেখেছিলাম। অনেকবার ভেবেছি চিঠি পাঠাবো। কিন্তু কী লিখব বুঝে উঠতে পারিনি। ক’বার ফোন নম্বর খুঁজে বের করে হাতে নিয়েছি, আবার রেখে দিয়েছি। সময় যত এগোচ্ছিল, তত দূর হয়ে যাচ্ছিলাম তোকে থেকে…”

অভি একটু হেসে বলে, “অথচ আমি এখনো সেই চাঁদনী গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি… আজও তোকে সেই লাল টিপ পরা মেয়েটার মতোই দেখি।”
রীমা চোখ নামিয়ে বলে, “তুই বদলাসনি অভি। এতগুলো বছর পরও তুই ঠিক আগের মতোই ভালোবাসিস…”
“ভালোবাসি না বললে মিথ্যে হবে রীমা,” — অভি একটু থেমে বলে, “আমি তো ভালোবাসতেই থেকেছি। কখনো বন্ধ হয়নি… শুধু মনে হতো, হয়তো তুই আর ফিরবি না…”
রীমা এবার একদম কাছে এসে দাঁড়ায়। চায়ের কাপে ধোঁয়া আর চোখে কিছু অশ্রু। ধীরে বলে, “তুই চাইলে… আবার শুরু করতে পারি? অনেক কিছু হারিয়েছি, আর কিছু হারাতে চাই না…”
অভির চোখ ভিজে ওঠে। সে ধীরে রীমার হাতটা ধরে। “এবার আর কোনো ভুল করব না। আর কিছু হারাবার মতো বয়স নেই আমাদের। এবার শুধু একসঙ্গে থাকার লড়াইটা চালিয়ে যাবো।”
Best New Bengali Love Story 2025
রীমা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ঠিক সেই সময় এক পশলা হালকা বৃষ্টি শুরু হয়। বারান্দার বাইরের গাছে জলবিন্দু জমে ওঠে। অভি আর রীমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে — যেন এতগুলো বছর পর জীবনের মানে আবার নতুন করে খুঁজে পায় তারা।
চায়ের কাপের পাশে পড়ে থাকা পুরনো স্মৃতিগুলো যেন ধুয়ে যাচ্ছে বর্ষার প্রথম ফোঁটায়।
তাদের গল্প নতুন করে শুরু হলো — আবার সেই চাঁদনী গলি থেকেই…
চাঁদনী গলির সেই একতলা বাড়িটার বারান্দায় বসে অভি আর রীমা মাঝরাত পর্যন্ত কথা বলেছিল। এত বছর পর, তারা যেন আবার নতুনভাবে একে অপরকে চিনছিল — ভালোবাসছিল।
পরদিন ভোরে, পাখির ডাক আর হালকা বাতাসে রীমার ঘুম ভেঙে গেল। চায়ের কাপ হাতে নিচে নামতে গিয়েই দেখে, বারান্দার পাশে একটা ছোট্ট চিরকুট পড়ে আছে।
“আজ সকালে একটু কাজ আছে। কিন্তু সন্ধেয় ওই পুরোনো গলি, যেখানে প্রথম একসাথে বসে ফুচকা খেয়েছিলাম — ওখানেই অপেক্ষা করবো। আসবি তো?
– অভি”
রীমা একটু হেসে চিরকুটটা বুকের কাছে টেনে ধরে। যেন তার পুরোনো কৈশোর ফিরেছে।
সন্ধ্যে ৬টা বাজতে না বাজতেই সে ছুটে যায় গলির মোড়ে — যেখান থেকে তাদের ভালোবাসার গল্প শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেখানে পৌঁছে দেখে, অভি নেই।
১০ মিনিট… ১৫ মিনিট… ২০ মিনিট…
অবশেষে অভি এল। হাতে একটা পুরনো ডায়রি, চোখে অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
“তোর জন্য কিছু এনেছি,” — অভি বলে ডায়রিটা রীমার হাতে দেয়।
রীমা কৌতুহল নিয়ে ডায়রিটা খোলে। ভেতরে একটা পাতায় লেখা:
“২৭শে জুন — তুই চলে যাবার পর প্রতিদিন একটা করে লাইন লিখেছি। যদি কোনোদিন আবার দেখা হয়, সবটা তোকে পড়ে শোনাবো বলেই…”
রীমার চোখ জলজল করে ওঠে। সে পাতা উল্টে উল্টে দেখে:
“আজ ওরকম লাল টিপ পরে আসিনি, কিন্তু মনে হচ্ছে রীমা আজও আমার পাশে বসে আছে।
আজও ফুচকার দোকানের সামনে দাঁড়ালাম, কিন্তু সে নেই…
আজ বুঝলাম, ভালোবাসা যদি সত্যি হয়, তবে সময় একে ধরে রাখে…”
রীমা চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ডায়রির গন্ধ নেয়। মনে পড়ে যায় সেই সব দিন, যখন অভিকে নিয়ে সে কত গল্প লিখত নিজের ডায়েরিতে।
“তুই সত্যি আজও আমায় ভালোবাসিস?” — রীমা ফিসফিসিয়ে বলে।
অভি হেসে বলে, “ভালোবাসা তো বন্ধ হয়নি রীমা, শুধু তুই ছাড়া সবকিছু বদলে গেছে। আমি শুধু তোকে নিয়েই থেমে ছিলাম…”
রীমা একপা এগিয়ে এসে অভির হাতে হাত রাখে।
“তাহলে চল, এবার সময় থামাব না — বাঁচবো একসঙ্গে। কারণ এই ভালোবাসার কাহিনি এবার আর অসমাপ্ত থাকবে না।”
ঠিক সেই মুহূর্তে এক ঝাঁক ফুচকার গন্ধ ভেসে আসে হাওয়ায় — সেই পুরোনো দোকান থেকে।
অভি বলে, “চল, আজ আবার সেই ফুচকার স্বাদটা ফিরিয়ে আনি।”
রীমা হাসে — এবার আর কোনো লুকোচুরি নেই, কোনো ভুল বোঝাবুঝি নেই।
তাদের ভালোবাসা এবার সময়ের পরীক্ষা পেরিয়ে জীবন নামক পথে একসঙ্গে হাঁটার জন্য প্রস্তুত।