ভোরের আলো ঠিক যেন মুহিবের জানালায় আসতেই হবে। আসবেই।
স্বপ্নগুলো সরে গেলো, রাতের জোছনার সাথে। মুহিব চোখ খুলেই ভাবল—আজ কি নতুন কিছু করতে পারবে?
সে বিছানা ছেড়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করল। তারপর ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। কিন্তু মনের মধ্যে একটা যুদ্ধ চলছে—নীরুকে সে এতবার ভালবাসার কথা বলেছে, তবুও সে কখনো একটা স্পষ্ট উত্তর দেয়নি। তার ৪৯তম প্রস্তাবও ব্যর্থ হয়েছে। আজ কি শেষ চেষ্টা করবে? নাকি এবার সত্যিই থেমে যাবে?
ভার্সিটিতে পৌঁছে সে খুঁজতে থাকল নীরুকে। ওর জানা মতে, নীরু পুকুরপাড়েই থাকবে। ঠিক তাই, নীরু বসে আছে, শাপলা ফুলের দিকে তাকিয়ে। এমনভাবে তাকিয়ে আছে, যেন ফুলগুলোর সৌন্দর্য আরও বেড়ে যাচ্ছে।
মুহিব গিয়ে পাশে বসলো। নীরু একবার তাকিয়েও দেখলো না।
শুধু বলল,
— “আজ নতুন কি নিয়ে এসেছো?”
মুহিব একটু হাসল।
— “আমাকে কি ভালবাসা সত্যিই যায় না?”
নীরু একটুও দেরি না করে বলল,
— “উত্তরটা জটিল। চেষ্টা চালিয়ে যাও, দেখো কি হয়।”
একটা হাসি দিয়ে সে চলে গেল।
মুহিব ক্লাসের ভেতর নীরুকে দেখছিল। কতো মনোযোগ দিয়ে স্যারের কথা শুনছে, কিন্তু মাঝে মাঝে মুখে একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠছে। মুহিব জানে, সে হার মানবে না। এবার তার ৫০তম চেষ্টা হবে শেষ এবং সেরা।
মুহিব এবার প্রস্তুত। নীরুকে সে বলল,
— “কাল ভোরে মরুর ব্রিজে আসবে? তোমার সাথে জরুরি কথা আছে।”
— “ভোরে? কেন?”
— “প্লিজ, একবার এসো।”
নীরু একটু ভেবে বলল,
— “ঠিক আছে, আসব।”
পরের দিন ভোরে, নীরু ব্রিজে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষার মেঘে রোদের লুকোচুরি খেলা চলছে। হঠাৎ, একটা ছোট ছেলে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে একটা কদম ফুল আর একটা ছোট্ট চিরকুট।
চিরকুট খুলে পড়লো—
“ভালবাসি তিনপাতার এক কদম ফুলটার সাথে।”
নীরু অবাক হয়ে দেখল, সত্যিই ফুলটার তিনটা পাতা।
তারপর একে একে আরও কয়েকজন ছোট ছেলে-মেয়ে এসে হাতে কদম ফুল দিয়ে গেলো, সাথে চিরকুট। প্রতিটাতে মুহিবের ভালবাসার নানা উপমা লেখা।
সবশেষে, একটা মেয়ে এসে তিনটা কদম ফুল আর একটা চিরকুট দিলো।
সেখানে লেখা ছিল—
“এগিয়ে যাও, আমি অপেক্ষায় আছি।”
নীরু সামনে এগিয়ে গেলো। ব্রিজের অপরপাশে একটা বটগাছের নিচে একটা বেঞ্চে মুহিব বসে আছে।
সে কাছে গিয়ে বসতেই মুহিব বলে উঠল,
— “নীরু, আজকের পর থেকে আর তোমাকে বিরক্ত করবো না। আমি জানি, আমি তোমার মনে জায়গা করতে পারিনি। তাই এবার সত্যিই চলে যাবো। ভালো থেকো।”
বলেই মুহিব উঠে দাঁড়ালো।
নীরু কিছু বলার আগেই সে চলে গেলো।
তার চোখে অশ্রু এসে গেলো। সত্যি কি সে মুহিবকে হারিয়ে ফেলল? সত্যি কি সে ওকে ভালবেসে ফেলেছে?
কিন্তু যদি মুহিব আর নতুন নতুন উপায়ে “ভালবাসি” না বলে, তাহলে?
সেদিনের পর থেকে মুহিব আর সামনে আসেনি। তবে সে দূর থেকে দেখতো।
নীরুর মন একদম ভালো নেই। তার বন্ধুদের সামনে সে কান্না করে ফেলল।
বন্ধুরা বলল,
— “শেষবার যেখানে দেখা করেছিলে, সেখানে গিয়ে দেখো।”
নীরু কিছু না ভেবে বিকেলে সেখানে গেলো। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে, এক অদ্ভুত নীরবতা।
সে বেঞ্চে বসে আছে। হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো। সে ছাতা খুলতেই দেখলো, পাশে একগুচ্ছ কদম ফুল রাখা।
সে দ্রুত ঘুরে তাকাল।
মুহিব দাঁড়িয়ে আছে।
মুহিব ধীরে ধীরে বলল,
— “একগুচ্ছ কদম হাতে ভিজতে চাই তোমার সাথে।”
নীরু কিছু না বলে দৌড়ে গিয়ে মুহিবের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
— “ভালবাসি… ভালবাসি… ভালবাসি… প্লিজ, আর দূরে যেও না।”
সে কাঁদছে, কিন্তু বৃষ্টির জলে সেটা দেখা যাচ্ছে না।
মুহিব অবাক হয়ে বলল,
— “তাহলে এতদিন দূরে রেখেছিলে কেন?”
নীরু ফিসফিস করে বলল,
— “তোমার নতুন নতুন ‘ভালবাসি’ বলাটা শুনতে চাইতাম।”
— “আমার কি ভালবাসা পেতে ইচ্ছে হয় না?”
নীরু হঠাৎ মুহিবের ঠোঁটে আলতো স্পর্শ করিয়ে দিলো।
তারপর বলল,
— “এখন থেকে ভালবাসবো।”
মুহিব হেসে বলল,
— “বাব্বা! কিছুদিন দূরে থেকে তো বেশ লাভ হয়েছে!”
নীরু অবাক হয়ে বলল,
— “মানে?”
মুহিব সব ব্যাখ্যা করলো, কিভাবে তার বন্ধুরা সাহায্য করেছিল।
নীরু একটু অভিমান করে চলে যেতে চাইল।
কিন্তু মুহিব তাকে টেনে নিয়ে বলল,
— “আর ছাড়বো না, পাগলীটা।”
— “সবাই কি আমাকে এভাবে ঠকাবে?”
— “না, না, তা হলে আমি জানতাম কিভাবে তুমি আমায় এতটা ভালবাসো?”
— “জানাটা কি খুব জরুরি ছিল?”
— “তা না হলে আমি যেতেই পারতাম…”
মুহিব হাঁটার ভান করতেই নীরু তার কলার ধরে বলল,
— “এবার হারালে একদম মেরে ফেলবো!”
— “তাহলে এত ভালবাসো আমাকে?”
— “হ্যাঁ, অনেক অনেক অনেক!”
— “এভাবে সবসময় ভালবাসবে?”
— “একটা শর্তে!”
— “কি শর্ত?”
— “নতুন উপায়ে ‘ভালবাসি’ বলাটা জারি রাখতে হবে!”
মুহিব মুচকি হেসে বলল,
— “আরে অবশ্যই, ম্যাডাম!”
নীরু আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
মুহিব বলল,
— “ম্যাডাম, একগুচ্ছ কদম হাতে কি ভিজবেন?”
নীরু ছোট্ট একটা হাসি দিলো।
দুজনে হাত ধরে হাঁটতে লাগলো, ভালোবাসার বৃষ্টির নিচে। ❤️
ভালবাসা ধৈর্য, বিশ্বাস, আর অপেক্ষার গল্প। যদি সত্যি ভালবাসা থাকে, তবে একদিন সেটা ঠিকই আপনার হয়ে আসবে। ❤️
বৃষ্টির জলে ভিজতে ভিজতে মুহিব আর নীরু একে অপরের হাত ধরে হাঁটছিল। যেন পুরো পৃথিবী তাদের জন্য থমকে আছে, শুধু আকাশ তাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে কাঁদছে।
নীরু এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল। মুহিব তার দিকে তাকালো।
— “কি হলো?”
নীরু কিছু বলল না। চোখের দিকে তাকিয়ে মুহিবের গালে আলতো করে হাত রাখলো।
— “তুমি জানো, আমি কেন এতদিন অপেক্ষা করছিলাম?”
— “কেন?”
— “আমি চাইনি, আমাদের ভালবাসা হুট করে হয়ে যাক। আমি চাইতাম, আমাদের গল্পটা অন্যরকম হোক। যেমনটা হয়েছিল…”
— “কিন্তু এই অপেক্ষার দিনগুলো আমার জন্য সহজ ছিল না, নীরু,” মুহিব মৃদু অভিমান নিয়ে বলল।
— “আমার জন্যও না। আমি শুধু চাইতাম তুমি নতুন নতুন উপায়ে বলো—‘ভালবাসি’। কিন্তু যখন তুমি সত্যি চলে যেতে চেয়েছিলে, তখন বুঝলাম… আর দেরি করা উচিত না।”
মুহিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
— “তাহলে এখন থেকে কোনো লুকোচুরি থাকবে না?”
নীরু হেসে বলল,
— “না, শুধু ভালবাসা থাকবে।”
পরদিন ভার্সিটিতে গিয়েই চারপাশে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। মুহিব আর নীরু একসঙ্গে এসেছে! এতদিন সবাই জানত মুহিব নীরুকে পাগলের মতো ভালোবাসে, কিন্তু নীরুর প্রতিক্রিয়া ছিল রহস্যে মোড়া।
ক্লাসে ঢোকার পরও বন্ধুদের কৌতূহলী দৃষ্টি তাদের পিছু ছাড়লো না।
আবিদ ফিসফিস করে বলল,
— “দোস্ত, কনগ্র্যাটস! কিন্তু আসল কথা হলো, নতুন নতুন প্রোপোজ চালিয়ে যেতে পারবি তো?”
মুহিব একটা কৌতুকপূর্ণ হাসি দিলো,
— “অবশ্যই! ভালবাসার খেলা এখনো বাকি!”
মুহিব ঠিক করল, তাদের প্রথম ডেটটা হবে অন্যরকম। ক্যান্ডেল-লাইট ডিনার বা সিনেমা নয়। কিছু স্পেশাল!
সে নীরুকে নিয়ে গেলো সেই পুরনো পুকুরপাড়ে, যেখানে সে একদিন শাপলার সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল।
মুহিব একটা ছোট্ট নৌকা ভাড়া করল। নীরু অবাক হয়ে বলল,
— “নৌকায় ডেট?”
— “হ্যাঁ, অন্যরকম কিছু না হলে তো তোমার পছন্দ হবে না, তাই না?”
নৌকা চলতে লাগলো। চারপাশে জলের নরম ঢেউ, চাঁদের আলোতে নীরুর চোখগুলো আরও উজ্জ্বল লাগছিল।
মুহিব একটা ছোট্ট বাক্স বের করল।
— “এইটা তোমার জন্য।”
নীরু অবাক হয়ে বাক্স খুললো। ভেতরে একটা ছোট্ট কাঁচের বোতল, তার মধ্যে একটা কদম ফুল আর একটা চিরকুট।
চিরকুটে লেখা ছিল—
“ভালবাসি ঠিক শাপলার মতো—সব সময় জলেই ডুবে থাকি, কিন্তু তোমার আলো পেলেই ফুটে উঠি।”
নীরু মুহিবের দিকে তাকিয়ে বলল,
— “তুমি সত্যিই থামবে না, তাই তো?”
মুহিব হাসল,
— “কখনোই না।”
নীরু ধীরে ধীরে বলল,
— “আমি চাইও না তুমি থামো।”
ভালোবাসার পথ সহজ নয়। কিছুদিন পরই নীরুর পরিবার জানতে পারল মুহিবের কথা।
— “এই ছেলেটা কে?” নীরুর বাবা জানতে চাইলেন।
— “আমার… বন্ধু,” নীরু বলল।
— “বন্ধু? নাকি এর বেশি কিছু?”
নীরু চুপ করে রইল।
তার বাবা গভীরভাবে তাকিয়ে বললেন,
— “তুমি জানো, আমাদের পরিবারের কিছু নিয়ম আছে। সম্পর্ক গড়তে হলে যোগ্যতা থাকা দরকার।”
নীরুর চোখ ছলছল করে উঠলো।
— “তোমার কি মনে হয়, সে যোগ্য না?”
— “সে কি পারে তোমাকে সুখে রাখতে?”
নীরু কোন উত্তর দিলো না, কিন্তু মনে মনে ভাবলো—সে কি আদৌ মুহিবকে হারাতে পারবে?
নীরুর পরিবারের প্রশ্নের উত্তর দিতে মুহিব পিছপা হলো না। সে নিজেকে প্রমাণ করার সিদ্ধান্ত নিলো।
সে পড়াশোনায় আরও মনোযোগ দিলো, ক্যারিয়ার গড়ার দিকে নজর দিলো।
কিন্তু এই দূরত্ব নীরুকে কষ্ট দিচ্ছিল।
একদিন রাতের বেলা নীরু হঠাৎ মুহিবকে ফোন করলো।
— “তুমি কি আমাকে ভুলে গেলে?”
— “না, বরং তোমার জন্য নিজেকে আরও যোগ্য করে তুলছি।”
— “কিন্তু আমি চাই না তুমি আমাকে পাওয়ার জন্য এত কষ্ট করো…”
— “তাহলে কী চাও?”
— “আমি শুধু চাই তুমি সবসময় আমার পাশে থাকো।”
মুহিব মৃদু হেসে বলল,
— “তাহলে আমি তোমার পাশে থাকার মতো যোগ্য হয়ে উঠবো। অপেক্ষা করো, নীরু।”
ভালোবাসা শুধু অনুভূতি নয়, এটা লড়াইও।
নীরু অপেক্ষা করতে লাগলো, মুহিব নিজেকে প্রমাণ করতে থাকলো।
একদিন, ঠিক সেই জায়গায়—বটগাছের নিচে বেঞ্চটিতে, নীরু দাঁড়িয়ে ছিল।
হঠাৎ মুহিব পেছন থেকে বলল,
— “একগুচ্ছ কদম হাতে এবার সারাজীবন তোমার সাথে থাকতে চাই, নীরু।”
নীরু চোখ বন্ধ করলো, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তারপর ধীরে ধীরে বলল,
— “হ্যাঁ, এবার আর দেরি করবো না।”
মুহিব নীরুর হাত ধরে বলল,
— “তাহলে, এবার থেকে প্রতিদিন একটা নতুন উপায়ে ‘ভালবাসি’ বলবো। রাজি?”
নীরু হাসল,
— “রাজি!”
(ভালোবাসার সত্যিকারের গল্প কখনো শেষ হয় না, বরং প্রতিদিন নতুন অধ্যায় শুরু হয়… ❤️)