নওশিন দরজা চাপিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বসে আছে। চোখে লেগে আছে অভিমান আর রাগের ছাপ। অন্যদিকে, ইমু ঘরে ঢুকেই বুঝতে পারে, আজ বড় কিছু হয়েছে। নওশিন চিৎকার করে বলল,
— এসে পড়েছো? আমি যাচ্ছি! আর কখনও ফিরব না। নিজের খেয়াল রেখো। আর শোনো, গরম বেশি, বেশি পানি পান করবে।
ইমু একদম থতমত খেয়ে গেল। সে জানত, নওশিন রাগলে “তুই” বলার মধ্যে তার ভালোবাসা লুকিয়ে রাখে। তবু এইবার কথাগুলো বেশ ভিন্ন লাগল।
ইমু ঠান্ডা গলায় বলল,
— আলমারির ড্রয়ারে কিছু টাকা আছে। নিয়ে যাও, পথে কাজে লাগবে।
নওশিন এবার কটমট করে তাকিয়ে বলল,
— তুই কি আমার পিছু পিছু আসবি?
ইমু মুখে হাসি এনে বলল,
— ধুর! আমার কি আর এত ফাঁকা সময় আছে? তুই কোথায় যাবি বলো? টিকিট কেটেছ? দরকার হলে কেটে দিই।
নওশিন রেগে গিয়ে বলল,
— তোকে কিছু বলব না। যে দিকে দু’চোখ যায়, সে দিকেই চলে যাব।
ইমু একটু দুষ্ট হাসি দিয়ে বলল,
— তোর চোখ তো আমার ছাড়া আর কোথাও যায় না।
নওশিন এবার মুখ ঘুরিয়ে বলল,
— আমি তোর বাবার বাড়িতে চলে যাচ্ছি। উনি আমাকে বলবেন, “কত ধানে, কত চাল।”
ইমুর মুখ থেকে হাসি উধাও। সে বুঝতে পারল, যদি নওশিন সত্যি তার বাবার কাছে চলে যায়, তাহলে তাকে নিশ্চয়ই কড়া ধমক খেতে হবে। ইমু ব্যাকুল গলায় বলল,
— পাখি, প্লিজ। যেও না। কাল তোকে সত্যি বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাব।
নওশিন একটু হেসে বলল,
— কাল তো? সেই “কাল” তো বিয়ের পর থেকে শুনছি। আজও লেকের পারে গিয়ে বসিনি। সবুজ গাছের নিচে একটু হেঁটেও দেখিনি।
ইমু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নওশিনও তার ব্যাগ নিয়ে দরজার দিকে হাঁটতে শুরু করল। ইমু হঠাৎ ছুটে গিয়ে নওশিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধরে বলল,
— পাখি, প্লিজ। আমি সত্যি বলছি, এবার তোমায় বাইরে নিয়ে যাব।
নওশিন হালকা কাঁপা গলায় বলল,
— তুমি কি আমায় সিরিয়াসলি কখনো নাও?
ইমু এবার নওশিনের হাত ধরে গভীরভাবে তাকিয়ে বলল,
— আমি তোমায় যতটা ভালোবাসি, সেটা কখনো বুঝতে দিই না। আমি তো শুধু চাই, তুমি সবসময় হাসো। আর সেই হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকি। প্লিজ, আমায় ছেড়ে যেও না।
নওশিনের চোখ ভিজে গেল। কিন্তু সে চট করে চোখ মুছে নিল। বলল,
— এবার তুমি নীচে গিয়ে আমার জন্য একটা আইসক্রিম নিয়ে আসবে।
ইমু একটু মুচকি হেসে বলল,
— তুমি না, সবসময় এমন নাটক করো!
— আর শোনো, আইসক্রিম না আনলে আজ সত্যি চলে যাব।
ইমু বাধ্য ছেলের মতো নীচে চলে গেল। আইসক্রিম নিয়ে এসে দেখল, নওশিন খিল খিল করে হাসছে।
নওশিন বলল,
— এলিয়েন, তোমার আর কেউ নেই। আমিই আছি। আর আমি সত্যিই তোমাকে ছেড়ে যাব না। তবে একটা শর্ত আছে।
— কি শর্ত?
— কাল বিকেলে ঠিক ৫টায় আমাকে নিয়ে লেকের পাশে যাবে। নইলে আর আইসক্রিম নয়।
ইমু মুচকি হেসে বলল,
— ঠিক আছে। আমি কাল বিকেল ৪:৫৫-তেই তৈরি থাকব।
পরদিন বিকেলে ইমু নওশিনকে লেকের পাশে নিয়ে গেল। তারা একসঙ্গে বসে নীরবতায় মিশে গেল। হঠাৎ, নওশিন ইমুর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
— জানো, আমি সবসময় তোমার যত্ন চাই, তোমার সময় চাই। আমার রাগ, অভিমান… এসব সবই তোমার প্রতি আমার ভালোবাসারই অন্য রূপ।
ইমু তার হাত ধরে বলল,
— আমি জানি। আর আমিও চেষ্টা করব, তোমায় সবসময় বুঝতে।
লেকের জলের মধ্যে তাদের দুই জনের প্রতিচ্ছবি যেন বলে উঠল, “একসঙ্গে সব ঝগড়ার মাঝেও ভালোবাসাই শেষ কথা।”
সকালবেলা।
ইমু লম্বা করে ঘুমাচ্ছে। আর নওশিন এক হাতে বালিশ ধরে আরেক হাতে ইমুর কানের কাছে চেঁচিয়ে বলছে—
নওশিন:
—এই ওঠো! সকাল হয়ে গেছে। তোমার ঘুম কি শেষ হবে না?
ইমু মুখ ঢেকে বলল,
—পাগলী, একটু শান্তি দাও। আমি রাতে ঘুমোইনি।
—রাতে তো দেখলাম মোবাইল নিয়ে বসে ছিলে। এত কী কাজ করো বলো তো?
—কাজ করছিলাম না, তোমার সাথে ঝগড়ার কথা ভাবছিলাম।
—তাই নাকি? কী ভাবছিলে?
—ভাবছিলাম তোমার মুখ বন্ধ করার উপায়।
নওশিন বালিশটা সরিয়ে ইমুর গালে একটা চিমটি কাটল।
—ঠিক আছে, এখন ওঠো। আজ তোমার প্রিয় খাবার রান্না করেছি।
ইমু:
—সত্যি? কী করেছ?
নওশিন:
—তোমার পছন্দের চিংড়ি মালাই কারি আর পোলাও।
ইমু:
—এত সকালবেলা পোলাও?
নওশিন:
—তোমার পছন্দ বলেই তো!
ইমু নওশিনের কথা শুনে মুখে হাসি নিয়ে উঠে বসে।
—ঠিক আছে। আমার তো খিদে পেয়েছে। চল, খেয়ে আসি।
(২য় পর্ব)
নাস্তার টেবিলে বসে ইমু চিংড়ি কারি খেতে শুরু করল। নওশিন এক পাশে দাঁড়িয়ে ইমুর খাওয়া দেখছে।
ইমু:
—তুমি বসে খাচ্ছ না কেন?
নওশিন:
—তুমি আগে খাও। আমি তোমার খাওয়া দেখছি।
ইমু একটু বিরক্ত হয়ে বলল,
—পাগলী, আমি তো আর সিনেমার নায়ক না যে আমাকে দেখেই তোমার পেট ভরে যাবে। চুপচাপ প্লেট নিয়ে বসো।
নওশিন হেসে বলল,
—তুমি আমার নায়ক, আর নায়কের খাওয়া দেখেই তো আমার পেট ভরে যায়।
ইমু মুখে চিংড়ি তুলে বলল,
—তুমি আর তোমার পাগলামি।
খাওয়া শেষ করে ইমু বলল,
—চল, আজ আমরা বাইরে একটু ঘুরে আসি।
নওশিন:
—সত্যি বলছ? মিথ্যা বলো না!
ইমু:
—সত্যি বলছি। এই নাও, শপথ করছি।
নওশিন খুশিতে লাফিয়ে উঠল।
—তাহলে চলো, আমি শাড়ি পরে আসছি।
(৩য় পর্ব)
বিকেলবেলা।
ইমু আর নওশিন একসঙ্গে লেকের ধারে বসেছে। আশপাশে অনেক দম্পতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। হালকা বাতাস বইছে।
নওশিন ইমুর কাঁধে মাথা রেখে বলল,
—তুমি জানো, আমি তোমার সঙ্গে এমনই কাটাতে চাই।
ইমু মুচকি হেসে বলল,
—তাহলে তো আমাদের জীবনের ঝগড়া-কাটাকাটির জায়গা থাকবে না।
—ঝগড়াগুলো থাকুক। কিন্তু শেষে এইরকম একসঙ্গে বসে থাকতে চাই।
ইমু:
—তুমি কি জানো, তোমার রাগ আমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের?
নওশিন:
—সত্যি?
ইমু:
—হ্যাঁ। কারণ তুমি যখন রাগ করো, তখন আমি আরও বেশি বুঝতে পারি যে, তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো।
নওশিন হেসে বলল,
—এইসব কথা বলে তো তুমি সবসময় আমাকে ভুলিয়ে দাও।
ইমু নওশিনের হাত ধরে বলল,
—আমি তোমাকে ভুলাই না। আমি তোমায় বোঝাতে চাই, তুমি আমার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
নওশিন লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
—তুমি এমন বললে তো আমার রাগ করতে ইচ্ছে করবে না।
ইমু অবাক হয়ে বলল,
—এই সময় কেক বানাব?
নওশিন:
—হ্যাঁ। কাল আমার জন্মদিন।
ইমু হতভম্ব হয়ে বলল,
—পাগলী, তুমি জন্মদিনের কথা আগে বলনি কেন?
নওশিন হেসে বলল,
—আমি চেয়েছিলাম তুমি নিজে মনে রাখো।
ইমু বলল,
—ঠিক আছে, চলো। রাতেই তোমার জন্য কেক বানাই।
নওশিন মুচকি হেসে বলল,
—তুমি আর তোমার পাগলামি।