ভোর ৬টা।
ঘুমের মাঝে আমি কেমন যেন মুচড়ে উঠলাম। শীতল ঠোঁটের কোমল ছোঁয়া দেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরাকে কম্পিত করে তুলল। চোখ খুলে দেখি, আমার “পরি” মুচকি মুচকি হাসছে।
— “এই ওঠো, সকাল হয়ে গেছে!”
— “হুম…” (ঘুমের মধ্যেই মৃদু আওয়াজে উত্তর দিলাম)।
— “হুম না, ওঠো!”
— “যাচ্ছ কোথায়? একটু আমার কাছে আসো না!”
— “আহা! কি করো? সবসময় দুষ্টুমি!?”
ওর মুখের হাসি যেন একটা ছোট্ট সূর্যের মতো উজ্জ্বল। ও আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,
— “ফ্রেশ হয়ে আসো, জলদি যাও।”
কিন্তু আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওকে জড়িয়ে ধরলাম শক্ত করে। ওর ভেজা চুলের সুবাস যেন আমাকে মায়ায় বেঁধে ফেলল।
— “এই ছাড়ো না প্লিজ!”
— “আরেকটু থাকি… শুধু একটু।”
ও তখন মিষ্টি রাগে আমার বুকে কয়েকটা ঘুষি মেরে পালিয়ে গেল। যাবার সময় জিভ বের করে “পরবর্তী বদলা” নেওয়ার ইঙ্গিত দিল।
ফ্রেশ হয়ে দেখি, পরি রান্নাঘরে। শাড়ি পরা অবস্থায় কোমরে আঁচল গুঁজে, চুলগুলো খোলা রেখে মিষ্টি হাসি নিয়ে সে রান্না করছে। ওকে দেখে মনে হল, যেন পুরো পৃথিবীর সৌন্দর্য ওই রান্নাঘরে এসে থেমে আছে।
আমি ধীরে ধীরে পেছন থেকে গিয়ে ওকে জাপটে ধরলাম।
— “উফফ, আবার শুরু করলে?”
— “তোমাকে দেখে কি আর লোভ সামলানো যায়! এত সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
ও চিমটি কেটে বলল,
— “রুটি পুড়ে গেলে, আমায় দায়ী করো না।”
আমি মজা করে হাল ছেড়ে দিয়ে রুমে চলে এলাম।
খাওয়ার সময় টেবিলে বসে পরিকে বললাম,
— “তুমি খাইয়ে দাও না?”
ও অবাক হয়ে বলল,
— “তুমি নিজের হাতে খেতে পারো না? দিন দিন আরও শিশুর মতো হচ্ছো!”
— “তবুও, খাইয়ে দাও প্লিজ।”
ও কিছুক্ষণ রাগ দেখিয়ে শেষমেশ খাইয়ে দিতে শুরু করল। আমি ওর হাতের রুটির স্বাদ নিতে নিতে বললাম,
— “বাহ, দারুণ হয়েছে!”
ও মিষ্টি হাসল।
এরপর এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে ওকে বললাম,
— “এই পরি, হা করো।”
ও বলল,
— “তুমি আগে খাও, তারপর আমি।”
— “না, হা করো প্লিজ।”
ও হেসে হেসে মুখ খুলল।
কিন্তু হঠাৎ দেখি, ওর চোখে জল!
— “এই পাগলি, কান্না করছো কেন?”
— “কিছু না… এমনিতেই চোখে পানি চলে এল।”
আমি ওর চোখের জল মুছে দিলাম। জানি, এই নীরব জল কতটা কথা বলে। ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে কখনও শব্দের দরকার হয় না।
ওকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে মনে মনে ভাবলাম,
“ভালোবাসা কখনও শুধু শব্দে সীমাবদ্ধ নয়। এটা অনুভূতির ভাষা, যা শুধু মনের গভীরেই বেজে ওঠে।”
দিনটা একটু ব্যস্ত ছিল। অফিসের কাজের চাপে সারাদিন পরি আর আমার কথাবার্তা খুব বেশি হলো না। তবে সন্ধ্যে নামতেই আমি ঠিক করলাম, আজ কিছু বিশেষ করব।
— “পরি, আজ একটু ঘুরতে যাব?”
ও চোখ তুলে তাকিয়ে বলল,
— “আজ? হঠাৎ কেন?”
— “তোমার জন্যই তো। অনেকদিন ঘোরাঘুরি হয়নি।”
ও একটু লাজুক হাসি দিয়ে বলল,
— “ঠিক আছে, কিন্তু বেশি দেরি করো না।”
রাতের খাওয়া সেরে আমরা বের হলাম। গাড়ি চালাতে চালাতে বললাম,
— “চোখ বন্ধ করো। একটা চমক আছে।”
ও বলল,
— “কোথায় যাচ্ছি আগে বলো।”
— “বললে চমক থাকবে কোথায়? চোখ বন্ধ করো, আর চুপচাপ থাকো।”
ও হেসে বলল,
— “আচ্ছা বাবা, করছি।”
পনেরো মিনিট পর গাড়ি থামিয়ে বললাম,
— “চোখ খুলে দেখো।”
ও চারপাশে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল।
আমরা শহরের বাইরে একটা নির্জন জায়গায়, যেখানে আকাশ ভরা তারারা ঝলমল করছে। কাছে একটা ছোট্ট পুকুর, জলের ওপর চাঁদের প্রতিচ্ছবি যেন কোনো গল্পের মায়াবী জগৎ।
— “তুমি এসব করেছো? এখানে কেন এনেছো?”
আমি বললাম,
— “তোমার জন্যই। এত কাজ আর ব্যস্ততার মাঝে আমাদের ছোট ছোট মুহূর্তগুলো যেন হারিয়ে না যায়। এটা তোমার আর আমার সময়।”
ওর চোখে জল চলে এল।
— “তুমি না, এমন সব করে আমায় আরও পাগল করে দাও।”
আমি হাসতে হাসতে বললাম,
— “পাগল করা তো আমার কাজ। তা ছাড়া, তুমি আমার পরি। তোমার জন্য কিছু করব না?”
ওর জন্য একটা ছোট্ট কেক এনেছিলাম। কেক কাটার সময় পরি বলল,
— “তুমি এত ভালো কেন?”
— “ভালো হতে হয়, কারণ তুমি আছো।”
ও হাসল, আর সেই হাসি যেন রাতের তারাগুলোকে হার মানিয়ে দিল। আমরা একসঙ্গে বসে আকাশের তারাদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। পুকুরের বাতাসে ওর চুলগুলো উড়তে লাগল। আমি আস্তে করে ওর হাত ধরলাম।
— “পরি, তোমার কি মনে হয়, এই মুহূর্তগুলোকে ঠিক এভাবেই ধরে রাখা যায়?”
ও বলল,
— “মুহূর্ত তো স্মৃতি হয়, কিন্তু ভালোবাসা চিরকালীন। তুমি আমার সঙ্গে থাকলে, প্রতিটি মুহূর্তই আমার কাছে এমন বিশেষ হয়ে থাকবে।”
আমি ওকে আরও কাছে টেনে নিলাম।
— “তুমি জানো, তোমার হাসি আর তোমার ছোট ছোট রাগই আমার জীবনের সবথেকে বড় সুখ।”
ও হেসে বলল,
— “আর তোমার দুষ্টুমি আমার সবচেয়ে বড় ভালো লাগা।”
ফিরে আসার পথে ওর মাথাটা আমার কাঁধে এলিয়ে দিল। গাড়ির ভেতর হালকা গান বাজছিল। ওর মুখের প্রশান্তি দেখে মনে হল, এই মুহূর্তগুলোই আমাদের জীবনের আসল সম্পদ।
— “এই মুহূর্তে তোমার কী ইচ্ছে করছে?”
— “ইচ্ছে করছে, সময় থেমে যাক। আমি আর তুমি এইভাবে চিরকাল থাকি।”
আমি গাড়ি থামিয়ে ওর কপালে একটা চুমু দিলাম।
— “সময় থামাতে পারব না, কিন্তু প্রতিটা মুহূর্তকে স্মরণীয় করে তুলতে পারব।”
ও কিছু বলল না। ওর চোখে আবার সেই জল। এই ভালোবাসার জল!
রাতে ঘরে ফিরে ও ঘুমিয়ে পড়ার পর, আমি ওর দিকে তাকিয়ে বসে রইলাম। মনে হল, পৃথিবীর সব থেকে মিষ্টি জিনিসটা আমার চোখের সামনেই। ওর নিঃশ্বাসের প্রতিটি শব্দ যেন একটা প্রেমের গান।
নিজের মনে বললাম,
“জীবনটা কেমন হতো, যদি তুমি না থাকতে? ভালোবাসা যেন তোমার নামেই লেখা।”
আর সেই রাতে, চাঁদ আর তারা সাক্ষী হয়ে থাকল, এক জীবনের অগণিত ভালোবাসার গল্পের।