রাস্তায় কোন মেয়ের সাথে মাখামাখি করে এসেছ বলো?”
সোহানার কণ্ঠস্বরে অভিমানের একটা তীব্র ঝাঁজ ছিল। সে রেগে গেলে তার চোখ দুটো যেন গভীর সমুদ্রের মতো হয়ে যায়—অস্থির, তীব্র, অথচ অদ্ভুত মায়াময়।
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অফিস শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন হাতে ছিল ওর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস—তাজা ইলিশ মাছ। কিন্তু দরজা খুলতেই দেখি ওর মুখে একগাদা অভিমান জমে আছে।
বুঝতে পারলাম, আজ কিছু একটা হয়েছে!
আমি জিজ্ঞেস করার আগেই ও আমার গায়ের ব্লেজার খুলতে গিয়ে আচমকাই থমকে গেল। একগুচ্ছ মেয়েলি সোনালী চুল ওর আঙুলের ফাঁকে ধরা পড়ে গেল!
চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল—
“এগুলো কী? কার চুল?”
আমার নিজেরও মাথা কাজ করছে না! আমি তো জানিই না এই চুল কোথা থেকে এলো।
“আমি… আমি জানি না!”—কথাটা এতটাই অসহায়ভাবে বেরিয়ে এলো যে, নিজেকেই কেমন দুর্বল লাগল।
সোহানা হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ঠোঁট কামড়ে বলল—
“ধুলোবালির সাথে উড়ে এসে বোতামে আটকে গেছে, তাই তো?”
আমি মাথা নাড়লাম।
“তাহলে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলে না? উড়োজাহাজে করে আসছিলে?”
আমি বুঝলাম, আজ যদি মহাকাশ থেকেও কোনো যুক্তি এনে দিই, ও তাতে কান দেবে না। কারণ ওর রাগ—সেটা ভালোবাসার অভিমানের রাগ, যে রাগে বড্ড মায়া লুকিয়ে থাকে।
আমি ধীরে ধীরে ওর সামনে গিয়ে বললাম—
“সোহানা, প্লিজ বিশ্বাস করো। তোমাকে ছাড়া আমার কোনো পৃথিবী নেই।”
সোহানা চোখ সরিয়ে নিল। অভিমানী মেয়েটার ভেজা চোখের কোণ যেন আমার বুকের গভীরে ছুরির মতো বিঁধছিল।
আমি সামনে এগিয়ে ওর গাল দুটো হাতে নিলাম। ও আমার হাত সরিয়ে দিয়ে তীব্র চোখে বলল—
“তুমি শুধু আমার, বুঝেছ? অন্য কোনো মেয়ের ছায়াও যদি তোমার গায়ে পড়ে, আমি…”
আমি বুঝতে পারলাম, এই মেয়েটার রাগ যতটা ভয়ানক, ভালোবাসাটা তার চেয়েও বহুগুণ বেশি।
ওর চোখে জল দেখে আমার ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। ওকে কাছে টেনে নিতে গেলাম, কিন্তু ও পেছনে সরে গেল। তারপর কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল—
“তুমি আমাকে সত্যি ভালোবাসো তো?”
আমি ওর হাতটা ধরে বুকের ওপর রাখলাম।
“এই হৃদয়ের প্রতিটা স্পন্দনে তুমি আছো, সোহানা। বিশ্বাস করো!”
সোহানা কিছু বলল না। আমি ওর দিকে একপলক তাকিয়ে চুপচাপ ফ্রিজ খুলে ইলিশ মাছটা রেখে দিলাম। আজ আর রান্না হবে না, বুঝতে পারছি।
রাতে সোহানা মুখ ফিরিয়ে শুয়ে ছিল। আমি ধীরে ধীরে ওর কাছে গেলাম। হাতটা ওর কোমরে রাখতেই ও ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। তারপর একঝটকায় উঠে বসে আমার শার্টের কলার চেপে ধরে বলল—
“শেষবার জিজ্ঞেস করছি! কোন মেয়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করেছ বলো?”
আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম—
“তোমার ভালোবাসার বাইরে আমি আর কোনো মেয়েকে দেখি না, সোহানা। তুমি ছাড়া আমার কোনো জগৎ নেই।”
সোহানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। তারপর হঠাৎ করেই ওর চোখে একটা অদ্ভুত নরম ভাব এল। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও আমার দিকে ঝুঁকে এলো, তারপর ওর উষ্ণ ঠোঁট আমার ঠোঁটের ওপর রাখা মাত্র আমি শিহরিত হয়ে গেলাম।
সেই চুম্বনে অভিমান গলে গেল, রাগটা কোথায় মিলিয়ে গেল, কেবল ভালোবাসাটা গভীর হয়ে ছড়িয়ে পড়ল আমাদের মাঝে।
আর আমি? আমি ওর আলিঙ্গনে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম—সেই চেনা, নিরাপদ, ভালোবাসার নরম উষ্ণতায়।
আপনার গল্পের গভীরতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছি, যেন পাঠকরা প্রতিটি লাইন অনুভব করতে পারে। কেমন লাগলো বলুন! 😊❤️
সেই রাতের পর আমাদের মধ্যে একটা নীরবতা তৈরি হয়েছিল। সোহানার ঠোঁটের উষ্ণতা আমাকে ছুঁয়ে গেলেও, ওর চোখের অভিমান এখনো রয়ে গেছে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি, সোহানা বিছানায় নেই। রান্নাঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে। আমি ধীরে ধীরে গিয়ে দেখলাম—ও চুপচাপ ইলিশ মাছ কেটে রাখছে। মুখে কোনো কথা নেই, শুধু মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে।
আমি পেছন থেকে গিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে ধরলাম।
“সোহানা, রাগ কমলো?”
ওর শরীরটা একটু কেঁপে উঠল, কিন্তু কিছু বলল না।
আমি ওর গালের পাশে মুখ এনে বললাম—
“প্লিজ, কথা বলো না গেলে মন খারাপ লাগে!”
সোহানা তখনও চুপ। আমি মজা করার জন্য ফিসফিস করে বললাম—
“কাল রাতে তুমি আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছো, এইটা কি আমি তোমার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারি?”
সোহানা এবার ধপ করে হাতের বটি নামিয়ে আমার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। চোখ দুটো মায়ায় ভরা, কিন্তু মুখ গম্ভীর।
“জোর করে? আমি তোমাকে জোর করে চুমু খেয়েছি?”
আমি হাসলাম। “হুম! কোনো অনুমতি ছাড়াই।”
সোহানা কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ আমার গালে একটা চিমটি কাটল!
“আবার বলবে?”
আমি মুখ বিকৃত করে বললাম—
“উফফ! ব্যথা লাগলো!”
ও এবার একটু হেসে ফেলল। সেই হাসিটাই তো আমি দেখতে চেয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ পর, আমরা একসাথে নাস্তা খেলাম। তারপর ওর পাশে বসে ওর হাতে হাত রাখলাম।
“সোহানা, বিশ্বাস করো। আমার জীবনে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই, কখনো ছিলও না।”
সোহানা গভীরভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল—
“আমি জানি… কিন্তু মাঝে মাঝে তোমাকে হারানোর ভয় পাই।”
আমি ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললাম—
“তুমি আমার হৃদয়ের মধ্যে আছো। তোমাকে হারানো অসম্ভব।”
সোহানা এবার মাথা আমার কাঁধে রাখল। বাইরে হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমি জানালার দিকে তাকিয়ে থাকলাম, আর মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম—এই মেয়েটাকে আমি কোনোদিন কাঁদতে দেব না।