সুইট আজ ভীষণ খুশি! যেনো আকাশের সমস্ত তারা একসঙ্গে তার চোখে নেমে এসেছে। কারণ আজ, অবশেষে, বর্ষা তার প্রপোজাল গ্রহণ করেছে! সুইটের মনে হচ্ছে পৃথিবীটা একসঙ্গে হাসছে, বাতাসে এক মিষ্টি সুর ভেসে আসছে। তার চারপাশে যেন শুধু বর্ষার সেই হাসি, সেই গালে টোল পড়া, সেই লাজুক ঠোঁট কামড়ে ধরা মুখ।
৩২ বার প্রত্যাখ্যানের পর অবশেষে ৩৩তম বার বর্ষা ‘হ্যাঁ’ বলেছে! কদম ফুল, গোলাপ, বেলী ফুল, চকোলেট, এমনকি শাপলা ফুল দিয়েও যখন লাভ হয়নি, তখনও সুইট হার মানেনি। সে জানত, একদিন বর্ষা বুঝবে, ভালোবাসা কখনও ফিকে হয় না, বারবার ফেরানোর পরেও ফিরে আসে।
সুইট আর বর্ষার পরিচয় ভার্সিটিতে। প্রথম দিনই দুজনকে একসঙ্গে র্যাগিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল। বড় ভাইদের আদেশ—একজন আরেকজনের কান ধরে টানবে! সুইট তখন খুশিতে লাফিয়ে উঠেছিল, এত সুন্দর একটা মেয়ের কান ধরে টানার সুযোগ! কিন্তু বর্ষা? সে তো তখন রেগে আগুন!
ঠিক টানার আগ মুহূর্তে সুইট বলে উঠেছিল,
“ভাইয়া, এত সুন্দর মুহূর্ত, ছবি তুলছেন না?”
এই কথা শুনে বর্ষা ফুঁসে উঠেছিল, কিন্তু এরই মধ্যে বড় ভাইরা হাসতে হাসতে ছবি তুলে নিয়েছিল। পরদিন সেই ছবি সবার ফোনে ভাইরাল! সবাই মজা করতে লাগলো, কেউ বলল ‘লাভ বার্ড’, কেউ বলল ‘মেড ফর ইচ আদার’!
এতেই বর্ষার রাগ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। সুইটকে একদম এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কিন্তু সুইটও নাছোড়বান্দা! হাসিমুখে, মজার কথা বলে, নানা ছোটখাটো উপায়ে বর্ষার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করতে লাগলো। আর একসময় সত্যি সত্যিই তারা ভালো বন্ধু হয়ে গেলো।
দুই বছর বন্ধুত্বের পর, সুইট প্রথমবার বর্ষাকে প্রপোজ করেছিল। কিন্তু বর্ষা প্রতিবারই ফিরিয়ে দিয়েছে। সুইট হাল ছাড়েনি। সে ভেবেছিল, একদিন এমনভাবে প্রপোজ করবে, যাতে বর্ষা আর না করতে না পারে!
সেই দিন অবশেষে এলো…
সুইট বর্ষার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। কিন্তু তার হাতে ফুল বা রিং ছিল না। বরং সে বর্ষার দিকে একজোড়া চশমা বাড়িয়ে দিলো।
“আমি তোমায় ভালোবাসতে বলছি না, শুধু চিরকাল আমার পাশে থেকো।
আমি চাই না তুমি আমাকে আদর করো, শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোতে দিও।
তোমাকে ভালোবাসতে হবে না, শুধু রান্না করার সময় পিছন থেকে জড়িয়ে ধরতে দিও।
তোমাকে ভালোবাসতে হবে না, শুধু প্রতিদিন সকালে তোমার ভেজা চুলের গন্ধে আমার ঘুম ভাঙতে দিও।”
বর্ষা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সুইট আবার বলল—
“যখন আমি বুড়ো হবো, তখনও কি তুমি আমার পাশে থাকবে?
যখন ভুল করে কিছু ফেলব, তখন কি তুমি রাগ না করে বুঝিয়ে দেবে?
যখন আমি আর ভালো শুনতে পাবো না, তখন কি তুমি ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনবে?
যখন আমি হাঁটতে পারবো না, তখন কি তুমি আমার হাত ধরে হাঁটাবে?
যখন আমি অসুস্থ হবো, তখন কি তুমি আমার যত্ন নেবে?
যখন আমি শেষ নিঃশ্বাস নেবো, তখন কি তুমি আমার হাত ধরে রাখবে?”
বর্ষার চোখ দুটো চিকচিক করছে। সে চুপচাপ তাকিয়ে আছে, যেনো হারিয়ে গেছে সেই ভবিষ্যতের কল্পনায়, যেখানে তাদের দুজনের একসঙ্গে বুড়িয়ে যাওয়া, একসঙ্গে থাকা…
সুইট হেসে বলল,
“তুমি কি আমাকে সেই সুযোগ দেবে? যাতে আমি আজীবন তোমাকে জ্বালাতন করতে পারি?”
তখন বর্ষার চোখের কোণ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আর মুচকি হেসে বলল—
“পাগল একটা!”
আজ তাদের বিয়ের দুই বছর পূর্ণ হলো।
সুইট এখনও বর্ষাকে সারাদিন জ্বালায়, আর বর্ষাও মুখে রাগ দেখিয়ে, হাসি মুখে সব মেনে নেয়। কখনো রেগে গেলে সুইটকে ইচ্ছেমতো বকা দেয়, আর সুইট সেই বকা শুনে হাততালি দিয়ে বলে,
“চমৎকার ভাষণ!”
বর্ষার রাগ তখন আরও বেড়ে যায়।
তারা দিনে যতই ঝগড়া করুক না কেন, সন্ধ্যা হলেই সব অভিমান গলে যায়। বর্ষার ঠোঁটে হাসি ফোটে, সুইটের চোখে ভালোবাসা জ্বলে ওঠে।
এই পাঁচ বছরে পৃথিবীর অনেক কিছু বদলেছে, কিন্তু তাদের ভালোবাসা একটুও কমেনি।
এ যেনো এক নিখাদ ভালোবাসার গল্প… যে ভালোবাসার কোনো শেষ নেই।
(বেঁচে থাকুক এমন সব ফরমালিনমুক্ত ভালোবাসা চিরকাল…) ❤️
৫ বছর পর…
সুইট আর বর্ষার সংসার কেটে যাচ্ছে এক রঙিন স্বপ্নের মতো। বিয়ের দুই বছর পরও তাদের মধ্যে সেই প্রথম দিনের রোমান্স এখনো অটুট। সকালে একে অপরকে দেখে দিন শুরু হয়, রাতে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়।
কিন্তু সুখের মাঝে কখনো কখনো ছোট ছোট ঝড় আসে, তাই না?
সুইটের স্বভাব আজও বদলায়নি। এখনও বর্ষাকে সারাদিন জ্বালায়, কখনো তার ফোন নিয়ে দৌড় দেয়, কখনো রান্নাঘরে গিয়ে দুষ্টুমি করে। বর্ষা রেগে যায়, বকাঝকা করে, কিন্তু দিনশেষে তার মুখের সেই ছোট্ট হাসিটাই বলে দেয়—সে এসব ভালোবাসে।
কিন্তু একটা পরিবর্তন এসেছে।
বর্ষা এখন আগের চেয়ে বেশি চুপচাপ থাকে। হাসে কম, ভাবে বেশি। সুইট এটা লক্ষ করেছে, কিন্তু কিছু বলছে না। সে জানে, বর্ষা নিজেই একদিন বলবে।
একদিন বর্ষাকে ছাদে নিয়ে গিয়ে সুইট বলল—
“এতো চুপচাপ কেনো? আমার তো মনে হচ্ছে, আমার বকবকানির উপর তোমার ইন্টারেস্ট কমে গেছে!”
বর্ষা একটু হাসল। তারপর বলল,
“সুইট, আমি তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে চাই।”
সুইট উচ্ছ্বসিত!
“সারপ্রাইজ? কি? আমাকে একটা গাড়ি কিনে দিয়েছো নাকি?”
বর্ষা হেসে মাথা নেড়ে বলল,
“না পাগল, তার চেয়েও বড় কিছু!”
সুইট আর অপেক্ষা করতে পারছে না।
“তাহলে বলো না!”
বর্ষা ধীরে ধীরে সুইটের হাত ধরল, আর তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল—
“তুমি বাবা হতে চলেছো!”
এক মুহূর্তের জন্য সুইট যেন পৃথিবীর সব শব্দ হারিয়ে ফেলল। তারপর তার মুখে এক বিশাল হাসি ফুটে উঠলো!
সে বর্ষাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তুলল!
“সত্যি?! তুমি মজা করছো না তো?”
বর্ষা হেসে বলল,
“না পাগল, একদম সত্যি!”
সুইট আনন্দে নাচতে শুরু করল!
“ওরে বাপরে! আমি বাবা হবো? ওহ মাই গড! আমাকে তো এখন অনেক সিরিয়াস হতে হবে! আমাকে তো বাবা হিসেবে ভালো উদাহরণ হতে হবে! আমাকে এখন বাচ্চাদের গল্প বলা শিখতে হবে, আর চকলেট বেশি খাওয়া বন্ধ করতে হবে!”
বর্ষা হাসতে হাসতে বলল,
“তোমাকে আগে নিজের যত্ন নিতে শিখতে হবে, তারপর বাবা হওয়া শিখো!”
সুইট এক মুহূর্ত থেমে বলল,
“শোনো, তোমাকে আমি কথা দিচ্ছি, আমি শুধু তোমার স্বামী নই, আমি আমাদের সন্তানের জন্যও সেরা বাবা হবো!”
সেই রাতে সুইট বর্ষাকে পাশে নিয়ে ছাদের নিচে শুয়ে চাঁদ দেখছিল।
সে বর্ষার কানে কানে বলল,
“তুমি জানো তো? পাঁচ বছর আগে আমি তোমাকে বলেছিলাম, আমি চিরকাল তোমার পাশে থাকবো, যখন তুমি কাঁদবে, আমি তোমার চোখের জল মুছবো, যখন তুমি হাসবে, আমি সেই হাসির কারণ হবো। আজও সেই কথা বলছি, শুধু এবার আমাদের জীবনে একটা নতুন অধ্যায় শুরু হতে যাচ্ছে… আমাদের ভালোবাসার ছোট্ট প্রতিচ্ছবি আসছে!”
বর্ষা সুইটের হাত শক্ত করে ধরল, আর তার চোখে এক চিলতে স্বপ্নের ঝিলিক।
তারা দুজনই জানত, সামনের দিনগুলো সহজ হবে না। কিন্তু তাদের ভালোবাসা যে কোনো ঝড়কে সামলানোর জন্য যথেষ্ট।
(চলবে…) ❤️